ভগবান, বাংলাদেশী সিনেমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো!

মুখ ও মুখোশ সিনেমার নির্মান কাহিনী জানেন? ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটা, কিন্তু নির্মান ইতিহাস কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৫৩ সাল থেকে সিনেমা নির্মানের প্রস্তুতি চলছিল। কেন একটি সিনেমা বানানো? কেন বাংলাদেশেই একটি সিনেমা বানানো? কারণ পাকিস্তানী সরকার নানান উছিলা দেখিয়ে বাংলাদেশে একটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তৈরীর স্বপ্ন গুড়িয়ে দিচ্ছিল – অজুহাতগুলো খুবই অদ্ভুত।

বাংলাভাষায় সিনেমা নির্মিত হলে দর্শক দেখবে না, বাংলাদেশীরা সিনেমা নির্মান করতে জানে না, পূর্ব পাকিস্তানের আবহাওয়া সিনেমা নির্মান শিল্পের উপযোগী নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মুখ ও মুখোশ ছিল একটি প্রতিবাদ মাত্র। আব্দুল জব্বার খান দেশীয় লোকজনকে নিয়ে নির্মান করে দেখিয়ে দিলেন বাংলাদেশেও বাংলাদেশীদের জন্য সিনেমা নির্মান করা সম্ভব। যদিও সিনেমার কারিগরী বেশ কিছু অংশই পশ্চিম পাকিস্তানে করা হয়েছিল কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুখ ও মুখোশ একটি আন্দোলনের যাত্রা করেছিল।

পরবর্তীতে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাভাষায় নির্মিত সিনেমাকে লড়াই করতে হয়েছে উর্দুভাষী সিনেমার সাথে, অস্তিত্বের সংগ্রামে জড়িয়ে থেকেছে সর্বক্ষন। এই ব্যবসায়ে টিকে থাকাটা সোজা ছিল না, তাই পয়সা উসুলের জন্য হলেও কিছু কিছু বাংলাদেশী পরবর্তীতে বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে উর্দূ ভাষায় ছবি নির্মান শুরু করেছিলেন।

স্বাধীনতার পরে সরকার একটা বিশাল কাজ করেছিলেন, দেশে হিন্দী এবং উর্দূ ভাষার ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল এদেশের সিনেমা শিল্পকে অন্তত: মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াবার সুযোগ করে দেয়া। সেই থেকে দেশে হিন্দী সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ। কিন্তু আবার তার অনুমতি দেয়া হলো, জানি না ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পকে কতটুকু দাড়িয়ে থাকতে দেবে।

কেন ভারতীয় সিনেমা চাই না? কারণ একটাই এদেশের সিনেমার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পে গত দেড়/দু দশক ধরে দৈন্যতা দেখা যাচ্ছে। পরিচালকরা নতুন এবং অভিনব কিছু দিতে পারছেন না, ভালো গল্পের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে অশ্লীল এবং যৌনউদ্দীপক দৃশ্য, গান ইত্যাদি। দর্শক হল থেকে বেরিয়েছেন, বন্দী হয়েছেন গৃহে, টিভিসেটের সামনে রিমোট হাতে জি সিনেমাসহ ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে। পরবর্তীতে তাদের রিমোট সরে গিয়ে জায়গা দখল করেছে সিনেমার ডিভিডি।

এই গৃহী দর্শককে আবার হলে ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে এসেছেন নতুন নতুন নির্মাতা। তারা তাদের মেধাকে বিকশিত করে স্বল্প বাজেটে নির্মান করছেন সেরা সেরা সিনেমা। দেশকে, দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। এই স্বপ্ন রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে আজই। কারণ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভারতীয় সিনেমাগুলোর নির্মান কলাকৌশল এবং বাজেটের সামনে দাড়াবার কোন ক্ষমতাই নাই বাংলাদেশী সিনেমার। এক থ্রী ইডিয়টস সারা বিশ্বে যতটাকা মুনাফা করেছে, বাংলাদেশী সিনেমায় সারাবছরের মুনাফাও বোধহয় তত না।

কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলছেন এতে বিনোদনসুযোগহীন মানুষের বিনোদনের সুযোগ আরেকটু বাড়লো। বাড়লো সিনেমার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীতা যা সিনেমার মানকে আরও ভালো করবে। কিভাবে করবে? বাংলদেশী সিনেমার কোন পরিচালকটার সাহস আছে তার এই দেশীয় নায়িকাটাকে উরুর উপরে স্কার্ট আর বুক পর্যন্ত জামা পরিয়ে খোলা রাস্তায় নাচাবে? কোন পরিচালকের এই ক্ষমতা আছে স্ক্রিপ্ট রাইটারের অসাধারন একটি গল্পের বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য কোটি টাকা বিনিয়োগ করার মতো একজন প্রযোজক খুঁজে বের করতে? কিভাবে সম্ভব একজন সিনেমা প্রদর্শককে কনভিন্স করতে যে কিনা একটা হিন্দী সিনেমা যা তাকে পুরো মাসই হাউসফুল বিজনেসের নিশ্চয়তা দেয় সরিয়ে অন্ততঃ এক সপ্তাহের জন্য হলেও সম্পূর্ন দেশে নির্মিত একটি ভালো গল্পের ভালো ছবি চালানোর জন্য?

দেশে ভারতীয় সিনেমা মুক্তি পেলে দেশের সিনেমা শিল্প কোথায় দাড়াবে তার জন্য কয়েকটি দেশের দিকে চোখ বুলানো যেতে পারে। যে পাকিস্তানে ৭১ এর পূর্বে তিনটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছিল সেই পাকিস্তান এখন দুর্বলভাবে টিকে আছে। ইসলামিক শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করা হলেও শিল্পসমালোচকরা এর পেছনে বলিউডের সিনেমার ব্যাপক প্রচলনকে দায়ী করছেন।

ইন্দোনেশিয়ায় ১৯২৬ সাল থেকে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। অথচ গত ২০০২ সালে এদেশের নিজস্ব সিনেমার সংখ্যা মাত্র ১০ টি, পূর্বের দুই বছরে এর সংখ্যা ছিল ৬ টি । সেই তুলনায় বাংলাদেশে আজে হোক বাজে হোক বছরে প্রায় ১০০ সিনেমা মুক্তি পায়, এই ১০০ সিনেমাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা হয় কোটি কোটি টাকা। আফসোস, হয়তো এখন থেকে এদেশে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়তো হবে কিন্তু তা হবে ১০/২০টি সিনেমাকে কেন্দ্র করে ।

এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কি হবে? কেউ করবে? সারা দেশে বাংলাদেশী সিনেমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনাকারী কোটি জনগন কি একটি ব্যানারের নিচে সমবেত হবে যেখানে লাল রং এ লেখা থাকবে- “আমরা বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমার প্রদর্শন চাই না”

সাধারণ মানুষ ভগবানকে কখন ডাকে? সম্ভবত যখন তার আর কোন ভরসার জায়গা থাকে না, যখন মনে হয় মানবীয় সকল প্রচ্ষ্টোই বৃথা, কোন ঐশ্বরিক শক্তিই পারে সমস্যার সমাধান করতে, তখনই মানুষ সব ভুলে গিয়ে স্রষ্টাকে স্মরন করে। আমার বুক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনে হয় চিৎকার করে স্রষ্টাকে ডেকে বলি, হে ভগবান, বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পকে তুমি বাচিয়ে রেখো, প্লিজ ভগবান প্লিজ…

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

One Comment on “ভগবান, বাংলাদেশী সিনেমাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *