পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার

পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার সিনেমার একটি দৃশ্য
পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার সিনেমার একটি দৃশ্য

পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ একই রকম – দুটো হাত, পা, চোখ, কান, নাক, মুখ – অথচ ভিন্ন তার ভাষা, কার্যাবলী। এ কারনেই কেউ হয় প্রেমিক, কেউ বা প্রেমের নিষ্ঠুরতার শিকার, কেউ যোদ্ধা, কেউ চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শিকার। বাহিরের পার্থক্য দৃশ্যমান হলেও ভেতরের পার্থক্যটা শুধুই অনুভবের। সে পার্থক্য ইন্দ্রিয়গত হলে তো কথাই নেই।

পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার‘ একটি অস্বাভাবিক প্রখর ইন্দ্রিয়ের গল্প। জার্মান লেখক প্যাট্রিক সাসকাইন্ডের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘পারফিউম’ যা কিনা পৃথিবীর ৪৫টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে, অবলম্বনে পারফিউম মুভিটি তৈরী করেছেন পরিচালক টম টাইকার। এ গল্প জ্যা ব্যাপ্টিস্ট গ্রানুইলির যে একজন ভাগ্যাহত মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্যারিসের এক মাছ বাজারের মধ্যে জন্ম নেয়া গ্রানুইলিকে তার মা অনাদরে ফেলে রেখেছিল পূর্বের চার সন্তানের মতই, জন্মের পরই মারা যাবার জন্য। কিন্তু গ্রানুইলি তো অন্যদের মত নয়, তাই মরেনি বরং বেঁচে উঠে এক অনন্য সাধারন ঘ্রানশক্তি নিয়ে।

সুগন্ধির রাজধানী ফ্রান্সের অষ্টাদশ শতাব্দীর এক নিপুন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মুভিতে। যেখানে পৃথিবীর সেরা সুগন্ধি তৈরী হয়, প্রতিনিয়ত হাজার হাজার লোক খেটে যায় সামান্য সুগন্ধি তৈরী করে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়ার, সেখানে প্রবল তীক্ষ্ম এবং সামান্য পার্থক্যকে আলাদা করার ক্ষমতা সম্পন্ন গ্রানুইলিই তো যোগ্য ব্যক্তি।

আশ্রমে বড় হওয়া গ্রানুইলিকে বিক্রি করে দেয়া হয় একজন চামড়া ব্যবসায়ীর নিকট। কঠোর পরিশ্রমে কেটে যাওয়া দিনগুলোর মধ্যেও গ্রানুইলি নিজেকে আবিস্কার করে নতুন করে – বহু দূরের, জলের তলের গন্ধও সে চিহ্নিত করতে পারে অনায়াসে। একদিন যোগাযোগ ঘটে যায় গুসেপ্পি বালদিনির সাথে যে কিনা একজন গন্ধবণিক।
শর্তসাপেক্ষে বালদিনি গ্রানুইলিকে শিখিয়ে দেয় ফুল থেকে তেল আহরনের উপায়, শিখিয়ে দেয় উপকরনের নামসমূহ আর সুগন্ধি তৈরীর উপায়। শিখতে থাকে গ্রানুইলি আর চলতে থাকে পরীক্ষা নিরিক্ষা, যদি তেরো ধরনের গন্ধ সংরক্ষন করা যায় তবে তৈরী করা সম্ভব হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সুগন্ধি। তারপর একদিন সে পাড়ি জমায় গ্রাসের পথে যেখানে তৈরী হয় পৃথিবীর বিখ্যাত সুগন্ধি সমূহ।

ফুল চাষাবাদের এবং সুগন্ধি তৈরীর কার্যাবলীর একটা বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে। বিশাল বিশাল ফুলের বাগানের সকল ফুল হাজার হাজার লোকের পরিশ্রমে নানাবিধ প্রক্রিয়ার পরে তৈরী হয় সামান্য একটু তেল আর তার সাথে বিভিন্ন উপকরন নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তৈরী হয় সুগন্ধি। সেই সুগন্ধি বিক্রি হয় সমাজের বিত্তশালী রুচিশীল ব্যক্তিদের মাঝে, সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধি প্রস্তুতকারকের। আড়ালে থেকে যায় গ্রানুইলির মতো ব্যক্তিরা, জীবনের গল্পটাই এরকম।

প্রতিভাবান গ্রানুইলি সংরক্ষন করতে চায় সুন্দরী নারীর দেহের মাদকতা, আর তাই নির্বিচারে হত্যা করে যায় একের পর এক সুন্দরী নারীদের। তাদের দেহ থেকে বিচিত্র উপায়ে সংগ্রহ করে নেয়া হয় গন্ধ, যে গন্ধ এর আগে কেউ কোনদিন সংগ্রহ করতে পারেনি। আর নগ্ন লাশটি পড়ে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। সুতরাং খোজ পড়ে যায় খুনীর যে কিনা শুধুই খুন করে কিন্তু কোন নির্যাতনের ছাপ রেখে যায় না। সবাই তটস্থ, কে বলবে পরবর্তী শিকার কে!

গ্রানুইলির চরিত্রে রূপদানকারী বেন হুইশা সম্পূর্ন চরিত্রটিকে তুলে ধরেছেন অসাধারন দক্ষতায়। একই চরিত্রে পাপহীনতা এবং নিষ্ঠুরতার বিস্ময়কর উপস্থাপন তাকে ভিন্ন রূপ দান করেছে। একবারেই নতুন বেন তার ভাঙ্গা চোয়াল, আর অবিন্যস্ত হাটাচলার মধ্য দিয়ে সেই বেনকেই তুলে ধরেছেন যা তুলে ধরেছিলেন লেখক প্যাট্রিক সাসকাইন্ড। পরিচালক টাইকার নিজেই বলেছেন নতুন এই অভিনেতা নির্বাচনের, “আমরা সেই অভিনেতাকে খুজছিলাম যে বইটির পাঠককে বিভ্রান্ত করবে না আবার নতুন দর্শককেও আকৃষ্ট করবে মূল উপন্যাসের প্রতি। বেন এ দিক থেকে সবচেয়ে যোগ্য” এ ধরনের চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা মুভিটি দেখলেই উপলব্ধি করা যায়, সম্পূর্ন মুভিটি গ্রানুইলিকে ঘিরেই আবর্তিত, বাকীরা সময়ের প্রয়োজনে এসেছে, চলেও গেছে।

গ্রানুইলি একজন প্রেমিক, কিন্তু তার নিজের কোন গন্ধ নেই, কেউ অন্যান্য সকল মানুষের মতো তাকে ভালোবাসবে না, প্রেমিক গ্রানুইলি তাই নিজের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কাজ করে যেতে থাকে। সকল উপকরন তৈরী করতে আর একটি মাত্র মেয়েকে হত্যা করলেই হয় -সে বেছে নেয় ধনাঢ্য বাবা অ্যান্টোনিও রিচির সুন্দরী মেয়ে লরাকে যে হবে তার তেরোতম উপকরন যে উপকরন সুগন্ধিকে অনন্য সাধারন করে তোলে।

তৈরী হয় শ্রেষ্ঠতম সুগন্ধি, কিন্তু ধরা পড়ে যায় গ্রানুইলি, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সারা শহর থেকে নারী পুরুষ সবাই জমায়েত হয়, তৈরীকৃত শ্রেষ্টতম সুগন্ধি নিয়ে হাজির হয় গ্রানুইলি, মাতিয়ে দেয় উপস্থিত সবাইকে। যে তৈরী করে পৃথিবীর শ্রেষ্টতম সুগন্ধি সে মানুষ নয়, অ্যান্জেল। সবাইকে মোহিত করে গ্রানুইলি হারিয়ে যায়, ফিরে যায় তার জন্মস্থানে। খালি করে দেয় বোতলের সকল সুগন্ধি, সে ঘ্রান নিতে ছুটে আসে সকল নারী পুরুষ আর সেই সুগন্ধির মধ্যেই মিশে যায় গ্রানুইলি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুগন্ধি প্রস্তুতকারক।

২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার মুভিটি তৎকালীন সবচেয়ে ব্যয়বহুল জার্মান মুভি। ওফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ৫২০০ জন এক্সট্রা, ১০২ টি বিশাল সেট, আর ৫২০ জন টেকনিশিয়ান কাজ করেছে মুভিটির নির্মানে। আর লোকেশন নির্বাচনে ইউরোপের আটটি দেশ চষে বেড়িয়েছেন নির্মাতা। সে কারনেই হয়তো ১৪৭ মিনিটের এই মুভিটি ১২টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

One Comment on “পারফিউম: দ্যা স্টোরী অব আ মার্ডারার”

  1. This review is representing the movie, as artistic as the movie. Allow me to thank you cordially mate.
    ———
    belayetalways
    somewhereinblog

Comments are closed.