লিসবেথ স্যালান্ডার এর জনক স্টিগ লারসন

স্টিগ লারসন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে মারা যান। সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন, হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক। শরীরের প্রতি প্রচুর অনিয়ম করেছিলেন তিনি। প্রচুর কফি খেতেন, অত্যাধিক মাত্রায় ধূমপান করতেন। খাওয়া দাওয়ার জন্য প্রসেসড ফুডসের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ফলে তার মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল না। ২০০৪ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুর এই ঘটনা ঘটে।

তিনি মারা যান সাংবাদিক পরিচয়ে। তার ক্রাইম থ্রিলার লেখক সত্তার জন্ম সাংবাদিক জীবনকালীন সময়ে হলেও মানুষের সামনে উপস্থিত হয় তার মৃত্যুর এক বছর পরে, ২০০৫ সালে। মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই তার লেখা তিন তিনটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা হয়। সবগুলো উপন্যাসের চরিত্রই লিসবেথ স্যালান্ডার। অর্থ্যাৎ তিনি লিসবেথকে নিয়ে একটি সিরিজ উপন্যাস লিখা শুরু করেছিলেন। ধারনা করা হয়, তিনি নিজের আনন্দের জন্যই এই সিরিজ লেখা শুরু করেছিলেন এবং এ কারণে প্রকাশের কোন প্রকার উদ্যোগই তিনি নেননি।

স্টিগ লারসন

তবে ভিন্ন কারণও থাকতে পারে। সুইডেনের আইন অনুযায়ী তাকে ষোল মাস সামরিক বাহিনীতে মর্টারম্যানের ভূমিকায় কাজ করতে হয়েছিল। যৌবনে তিনি এক্সট্রিম বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এমনকি, ইরিত্রিয়ায় মহিলা গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। কিডনীর সমস্যায় ভুগে এই কাজ তিনি বেশিদিন করতে পারেন নি।

স্টকহোমে ফিরে এসে তিনি সাংবাদিকতার সাথে পুরোপুরি নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তবে পাশাপাশি তিনি সুইডেনের ডানঘেঁষা উগ্রপন্থা নিয়ে গবেষনার সাথে যুক্ত হন। সুইডিশ ভাষায় তিনি ‘দ্য এক্সট্রিম রাইট’ নামের একটি গবেষনাগ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। এই সকল কারণে তিনি অনেকবার হত্যার হুমকী পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। হুমকী যেন বাস্তবায়িত হতে না পারে সেজন্য তিনি তার সঙ্গীনীকে নিয়ে অনেকটা গোপনে বসবাস করতেন। বলা হয়, তারা বিয়ে করেননি গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কারণ আইন অনুযায়ী বিয়ে করতে ইচ্ছুক নারী ও পুরুষকে তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা প্রকাশ করতে হয়। সুতরাং ক্রাইম থ্রিলার উপন্যাস প্রকাশ করতে না চাওয়ার এটিও একটি কারণ হতে পারে৷

যাহোক, পাণ্ডুলিপিগুলো উদ্ধার হওয়ার পর সেগুলো ‘মিলেনিয়াম সিরিজ’ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়। বইগুলোর নাম – দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু (২০০৫), দ্য গার্ল হু প্লেইড উইথ ফায়ার (২০০৬) এবং দ্য গার্ল হু কিকড দ্য হর্ণেটস নেস্ট (২০০৯)। প্রথম উপন্যাসটি প্রথমে সুইডিশ ভাষায় এবং পরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরের দুইটিও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং বেস্ট সেলার খেতাব পায়। কিছু পুরস্কারও অর্জন সম্ভব হয়।

স্টিগ লারসনের লেখা তিন উপন্যাসের প্রচ্ছদ (ছবি: the Evanston Public Library)

এই খ্যাতির কারণেই প্রকাশিত তিনটি উপন্যাস থেকেই পরবর্তীতে সুইডিশ ভাষায় ‘মিলিনিয়াম ফিল্ম ট্রিলজি‘ নির্মিত হয়। তিনটি সিনেমাই যে সফল হবে তা প্রযোজক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণে একত্রে তিনটি সিনেমার নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং একই বছরে তিনটি সিনেমাই মুক্তি দেয়া হয়। দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু মুক্তি পায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে, দ্য গার্ল হু প্লেইড উইথ ফায়ার সেপ্টেম্বর মাসে এবং দ্য গার্ল হু কিকড দ্য হর্ণেট’স নেস্ট মুক্তি পায় নভেম্বর মাসে।

সুইডিশ সিনেমাগুলোর পোস্টারগুলোও লক্ষ্যনীয়। তিনটা পোস্টারই রাতের দৃশ্যকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং তিনটি পোস্টার তিন ধরনের কাহিনীকে তুলে ধরেছে।

মিলেনিয়াম ট্রিলজির জনপ্রিয়তা এবং ব্যবসায়িক সফলতা হলিউডেও পৌঁছায়, ফলে ডেভিড ফিঞ্চার প্রথম সিনেমাটি রিমেক করেন যা মুক্তি পায় ২০১১ সালে। সুইডিশ এবং হলিউড ভার্সনের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। দর্শকের রুচির উপর নির্ভর করবে কোন সিনেমাটি পছন্দ হবে।

স্টিগ লারসনের সৃষ্টি লিসবেথ স্যালান্ডারের চরিত্রটি ভীষণ প্রতিবাদী। নারীবাদী চরিত্র হিসেবে একে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। স্টিগ লারসন কেন একজন নারীবাদী নারীকে তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে তৈরি করেছিলেন তার একটা জবাব পাওয়া যায় তার সঙ্গিনী ইভা গ্যাব্রিয়েলসনের লেখা বই ‘There are things I want you to know about Steig Larsson and Me’- এ৷ স্টিগের বয়স যখন পনেরো বছর তখন তার সামনেই তার তিন বন্ধু একটি মেয়েকে ধর্ষন করেছিল। এই ঘটনাটি স্টিগের মনে দারুন রেখাপাত করেছিল যা পরবর্তী সময়ে ইরিত্রিয়ায় মহিলা গেরিলাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান কিংবা লিসবেথকে কেন্দ্র করে সিরিজ উপন্যাস লেখাকে জাস্টিফাই করে৷

এক লেখকের তিনটি উপন্যাস, তিনটিই বেস্ট সেলার, তিন উপন্যাস থেকে সিনেমা নির্মিত চারটি সিনেমাই ব্যবসাসফল অথচ ঔপন্যাসিক বেঁচে নেই – বিষয়টি পাঠক এবং দর্শক উভয়ের জন্যই বেদনাদায়ক।

লিসবেথ স্যালান্ডার চরিত্রের তিন অভিনেত্রী – নুমি র‌্যাপেস, রুনি মারা এবং ক্লেয়ার ফয় (ছবি: IndieWire)

কিন্তু স্টিগ লারসনের থলেতে আরও কিছু ছিল। লিসবেথ স্যালান্ডারকে নিয়ে চতুর্থ উপন্যাসের তিন চতুর্থাংশ লিখে গিয়েছিলেন তিনি যা তার পার্টনারের কাছ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আরও পাওয়া যায় পঞ্চম ও ষষ্ঠ উপন্যাসের সারসংক্ষেপ। সম্ভবত তিনি সর্বমোট দশটি উপন্যাস লিখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

২০১৩ সালে ডেভিড ল্যাগারক্রাঞ্চ নামে একজন সুইডিশ লেখক ও সাংবাদিক স্টিগ লারসনের উপন্যাসগুলো সম্পূর্ণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় স্টিগ লারসনের পঞ্চম উপন্যাস – দ্য গার্ল ইন দ্যা স্পাইডার্স ওয়েব। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় – দ্য গার্ল হু টেকস অ্যান আই ফর অ্যান আই।

চতুর্থ এই উপন্যাস অবলম্বনেও সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এ বছরের অক্টোবরে পর্দায় মুক্তি পেয়েছে লিসবেথ স্ল্যান্ডারের চতুর্থ সিনেমা – দ্য গার্ল ইন দ্য স্পাইডার্স ওয়েব।

লিসবেথ স্যালান্ডারের আমেরিকান ভার্সনে অভিনয় করেছিলেন রুনি মারা, সুইডিশ ভার্সনে নুমি র‍্যাপেস। সুইডিশ ট্রিলজির প্রথম পর্ব নির্মান করেছিলেন নীল আরদে অপলেভ এবং বাকী দুই পর্ব ড্যানিয়েল আলফ্রেডসন। চতুর্থ পর্বের সিনেমায় নেই এদের কেউই। ফেড আলভার্জের পরিচালনায় লিসবেথ স্যালান্ডার হয়েছেন ক্লেয়ার ফয়।

দশটি উপন্যাসের সারসংক্ষেপের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় না। হতে পারে বিষয়টি প্রকাশকের স্টান্টবাজি, স্টিগ লারসনকে বড় করে তোলার জন্য এই তথ্যটি প্রচার করেছেন। এই ধারণার পিছনে যুক্তি রয়েছে। ২০১১ সালে স্টিগ লারসন কেন এত জনপ্রিয় তা সন্ধান করে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দ্য নিউ ইয়র্কার-এ। সেখানে স্টিগ লারসন সম্পর্কে এমন কিছু তথ্যের সন্নিবেশ করা হয় যা তার উপন্যাসগুলি সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে।

স্টিগ লারসনের সাথে একত্রে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, স্টিগ লারসন খুব ভালো লেখক ছিলেন না। তার উপন্যাসগুলির ইংরেজি ভার্সন প্রকাশের আগে প্রচুর সম্পাদনা করা হয়েছে। আর্টিকেলের লেখক জানিয়েছেন, সুইডিশ ভার্সনের উপন্যাসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক বিষয় ছিল, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রসঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা, যা পাঠককে বিরক্ত করে তুলতে যথেষ্ট, কখনও কখনও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতেও পারে৷ ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে পাঠকের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। উপন্যাস অবলম্বনে যখন চলচ্চিত্র নির্মান করা হয়েছে তখন নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডীতে বাঁধার জন্য আরও কাটছাঁট চালানো হয়েছে। অন্যদিকে, বড়পর্দায় সুইডিশ মিলেনিয়াম ট্রিলজি মুক্তির পর বইয়ের বিক্রি বেড়েছে বহুগুণ। সব মিলিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন স্টিগ লারসন এবং লিসবেথ স্যালান্ডার।

আর্টিকেল লেখকের এই দাবীকে একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্টিগ লারসনের পরিচয় ছিল সাংবাদিক এবং গবেষক, যদিও তার লেখালিখির জীবন শুরু হয়েছিল সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে। কৈশোরকাল থেকেই তিনি সায়েন্স ফিকশনের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন এবং সায়েন্স ফিকশনের ভক্তদের বেশ কিছু সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এইসব সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ফ্যান ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়েছিল। তিনি এসব এবং এ ধরণের অন্যান্য ম্যাগাজিনের জন্য সায়েন্স ফিকশন লিখেছিলেন। পরবর্তীতে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে ব্যস্ত হওয়ায় তার ফিকশন লেখালিখিতে ছেদ পড়ে।

আরও একটি যুক্তি আছে। আগেই বলেছি, ধারণা করা হয় তিনি উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন মনের আনন্দে। বর্তমান সময়ে এ ধরণের উপন্যাস বাণিজ্যিকভিত্তিতে প্রকাশের আগে বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পাদিত হয়। বাণিজ্যিক সফলতা নিশ্চিত করার জন্য অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন বাদ দেয়া হয়, তেমনি প্রয়োজনীয় অংশ যোগও করা হয়। এই কাজগুলো করার জন্য কিছু দক্ষ, প্রফেশনাল মানুষও আছে। স্টিগ লারসনের জীবৎকালে উপন্যাসগুলো এই ধাপগুলোর কোনটি উৎরানোর চেষ্টাই করেনি।

স্টিগ লারসনের প্রতি সবচেয়ে ভয়াবহ যে অভিযোগটি, তা হল, এই উপন্যাসগুলো তিনি লিখেনইনি, তার নামে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র! তবে কে লিখেছেন? তার সঙ্গিনী, ইভা গ্যাব্রিয়েলসন। সাংবাদিকদের কেউ একজন ইভাকে এই প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে তিনি লিসবেথ স্যালান্ডারের মতই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা লিখেছি।’ ইভা লিখেছেন, এই উত্তরটি অনেক গ্রহণযোগ্য, কারণ তিনি আগে থেকেই লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বেশ কিছু বইয়ের সহলেখক। স্টিগ লারসনের মৃত্যুর পরে ‘There are things I want you to know about Steig Larsson and Me’ বইটি প্রকাশ করেছেন যার মাধ্যমে স্টিগ লারসনের অনেক বিষয় জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর কোনটিই অবশ্য গল্প বা উপন্যাস নয়। তবে স্টিগের উপন্যাসগুলো লেখার সময় তিনি বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন।

উপন্যাসগুলো যেই লিখুক না কেন, লিসবেথ স্যালান্ডারের জনক যে স্টিগ লারসন সেই বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। বর্তমান সময়ে অনেক লেখকের সৃষ্টিকেই অন্য কেউ নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন, সামনেও করা হবে। তাছাড়া, স্টিগ লারসন অন্য কারও সৃষ্টিকে নিজের নামে চালিয়ে দেন নি এবং কেউ যদি নিজের সৃষ্টিকে স্টিগ লারসনের নামে চালিয়ে দেয় তার জন্য স্টিগ লারসনকে দোষ দেয়া যায় না।

দ্য গার্ল ইন দ্যা স্পাইডার’স ওয়েব সিনেমাতেও স্টিগ লারসনকে পাওয়া গিয়েছে। এর পরের উপন্যাস বা সিনেমায় তাকে আর পাওয়া যাবে না। তবে ইয়ান ফ্লেমিং বা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের মত তার সৃষ্ট চরিত্র লিসবেথ স্যালান্ডার হয়তো টিকে যাবে। সে যাই হোক, নিশ্চিত থাকুন, লিসবেথকে নিয়ে পঞ্চম সিনেমাটিও নির্মিত হবে, যার নাম হবে দ্য গার্ল হু টেকস অ্যান আই ফর অ্যান আই!

এই লেখাটি দেশ রূপান্তর এ প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *