গজারিয়ার শিপইয়ার্ডে

‘এই জাহাজটা সাত তলা। আপনি এখন যে ফ্লোরে আছেন এর নিচে আরও দুই ফ্লোর আছে, উপরে চার ফ্লোর। আসুন, ঘুরে দেখাই।’

যে জাহাজের কথা বলছি তার নাম এমভি ইহসান -১। মেঘনা সেতুর গোড়ায় মেঘনা ইকনোমিক জোনে অবস্থিত মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ঘাটে জাহাজটি আজ সকালেই নোঙর করেছে জেনে দেখতে এসেছি। ইহসান শিপিং লিমিটেড কোম্পানির প্রতিনিধি আমাদের উদ্দেশ্যে উপরের কথাগুলো বললেন।

এই কার্গো জাহাজটির নির্মান শেষ হয়েছে তিন সপ্তাহ আগে। মাত্র একবার সমুদ্রে গিয়ে এসেছে। বেশ বড় এবং আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ শিপ।

পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে এই গল্পটি পিডিএফ আকারেও প্রকাশ করা হয়েছে। পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়তে ছবিতে অথবা এই লিংকে ক্লিক করুন।

‘ক্যাপ্টেন কই?’ – প্রশ্ন করলেন মনিরুজ্জামান ভূঞা স্যার। আমাদের তিনজনের টিমের উনিই লিডার। আর আছেন সুজাত আলী স্যার। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের একজন প্রিন্সিপাল অফিসার, মাহফুজ ভাই, আমাদের সাথে আছেন। ইহসান শিপিং এর প্রকল্প ঋণ উনিই ডিল করেন।

ক্যাপ্টেন জাহাজে খুব কাছেই ছিল, লোক পাঠানো লাগল না, দশ পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে হাজির হলেন।

ভালো আছেন?
জ্বি স্যার।
কেমন চলল শিপ।
জ্বি স্যার খুব ভালো। কোন সমস্যা হয়নি। মেশিন ভালো স্যার, চট্টগ্রাম থেকে আমরা ফিরেছি স্যার আটত্রিশ ঘন্টায়। লোডেড। আগে স্যার তিনদিনও লাগছে।
বাড়ি কি বরিশাল?
জ্বি স্যার, উজিরপুর।
কতদিন চালাচ্ছেন লঞ্চ?
ষোল বচ্ছর হবে স্যার।
কি নাম আপনার?
আবদুল ওয়াহাব স্যার।
তো ওয়াহাব সাহেব, আমাদের দেখান আপনার শিপ।
জ্বি স্যার। অবশ্যই। আসেন স্যার।

শিপের ভেতরে একে একে আমরা সবাই ঢুকলাম। কার্গো শিপের প্রধান উদ্দেশ্য মালামাল পরিবহন করা, ফলে ঘুরে দেখার মত তেমন কিছু থাকে না। সাধারণত ক্যাপ্টেন আর ক্রুদের থাকা-খাওয়া আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য বিভিন্ন কক্ষ দিয়ে ফ্লোরগুলো সজ্জিত। একদম উপরের ফ্লোরে নেভিগেশন রুম, ওখানে বসেই ক্যাপ্টেন জাহাজ পরিচালনা করেন। নিচের দিকে থাকে জাহাজের ইঞ্জিন, জেনারেটর ইত্যাদি। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের নিচের দিকে নিয়ে গেলেন।

সাত-তলা জাহাজ বলা হলেও মনে রাখতে হবে পুরো জাহাজটি সাত তলা নয়। জাহাজের মালামাল পরিবহন অংশটি হয়তো তিন বা চারতলা উচ্চতার হবে। পরিচালনার অংশটি সাত-তলা উচ্চতার। লঞ্চ-শিপের সাথে আমার পরিচয় বাচ্চাবেলা থেকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে ঢাকা বরিশাল রুটে। সেগুলো সম্পর্কে আমার বেশ ভালো ধারণা রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে শৈশব কাটানোর কারণে বড় মালবাহী জাহাজ, অয়েল ট্যাঙ্কার দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ফলে লঞ্চ-জাহাজ দেখার ব্যাপারে আমার আগ্রহ খুব বেশি না, কিন্তু এই শিপটা ঘুরে দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতেও পারছি না, চাপা এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে।

যে ধরনের জাহাজে এখন আমরা দাড়িয়ে আছি এগুলোকে লাইটারেজ জাহাজও বলে। মূলত বিদেশ থেকে বিশাল আকৃতির যে জাহাজগুলো (মাদার ভেসেল) কন্টেইনার বোঝাই হয়ে আমাদের দেশে আসে তারা সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। তারা নোঙর করে মাঝ সমুদ্রে। মাদার ভেসেলে থেকে মাল খালাসের কাজ করে লাইটারেজ জাহাজগুলো। ছোট কার্গো জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অন্যান্য জায়গায় মালামাল স্থানান্তর হয়।

আপনাদের এই জাহাজের ক্যাপাসিটি কত? – ইহসান শিপিং কোম্পানীর প্রতিনিধির কাছে জানতে চাইলেন সুজাত স্যার।
স্যার, এটা তো প্রথমে কন্টেইনার পরিবহনের চিন্তা করা হয়েছিল। পরে কার্গো আনা-নেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ কারণে ক্যাপাসিটি অনেক বেড়ে গেছে স্যার। এখন স্যার ৫৭০০ টন ক্যারি করতে পারে।
খরচ কত পড়ল?
৬৫ কোটি টাকা স্যার। দুইটা মিলে ১৩০ কোটি টাকা।
অন্যটা তো এখনো নামানো হয়নি, না?
জ্বি স্যার, আগামী জুন নাগাদ নামবে আশা করা যায়।
জাহাজটা লম্বায় কতটুকু হবে?
প্রায় সিক্সটি মিটার স্যার। এই জাহাজ কিন্তু সমুদ্রেও চলতে পারবে স্যার।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার। এটা কিন্তু একদম মাদার ভেসেলের গায়ে ভিড়েছে। সেখান থেকে মাল লোড করে সরাসরি এখানে চলে এসেছে।

প্রতিনিধি ভদ্রলোক না জানলেও আমি জানি, সুজাত স্যার এসব তথ্য আগে থেকেই জানতেন এবং এখন ঝালাই করে নিলেন। ইন ফ্যাক্ট, এমভি ইহসান দেখতে আসার কারণ সুজাত স্যারই। গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ইহসান শিপিং সম্পর্কে পড়াশোনা-গবেষনা চলছে। ইহসান শিপিং এর জাহাজটা যে দেখা উচিত, সেটা তিনিই ইহসান শিপিং এর ফাইল পড়াশোনা করে ভূঁইয়া স্যারকে রাজী করিয়েছেন।

আমরা প্রথমে নিচের দিকে নামলাম। একদম নিচের ফ্লোরে দুটো শক্তিশালী ইঞ্জিন বসানো হয়েছে। এছাড়া আছে দুটো বড় জেনারেটর। ইঞ্জিন রুম বেশ অন্ধকার জায়গা, খুব একটা প্রশস্তও নয়। তেল কালি ইত্যাদির গন্ধ আছে। আমরা এক নজর দেখে উপরের দিকে চললাম।

উপরের দিকের ফ্লোরগুলোয় ক্রুদের কেবিন, স্টোর রুম ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। একদম উপরের ফ্লোরে নেভিগেশন রুম। খুবই চমৎকার সাজানো গোছানো একটি রুম। জাহাজের পেছনের দিকে এর অবস্থান বলে জাহাজের সামনের পুরো দিকটিই কন্ট্রোল রুম থেকে দেখা যায়। জাহাজ চালানোর জন্য বড় একটা হুইল আছে। তবে ক্যাপ্টেন সাহেব জানালেন, এই হুইল তারা এখন অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার করে। মোট চারটি উপায়ে জাহাজকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় – যার তিনটি অটোমেটিক আর একটি ম্যানুয়াল। বড় হুইলটি ম্যানুয়ালি চালাতে হয়। বাকী তিনটির অন্তত দুটি অকার্যকর হলে তবেই ম্যানুয়ালি অপারেট করার প্রয়োজন পড়বে।

জাহাজের কার্গো অংশের অর্ধেকের ছাদ উন্মুক্ত। একটা বিশাল ক্রেন হা করা মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে কার্গোর পেটের ভেতরে, বন্ধ মুখের ভেতরে তুলে আনছে কয়েক মন গম, তারপর সেই গম নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে বিশাল এক ফানেলের মধ্যে। কে জানে হয়তো সেই গমই একেবারে আটা ময়দা হয়ে বের হচ্ছে। কার্গোর ছাদ খোলা বন্ধ করার কাজও ক্যাপ্টেনের ডেক রুম থেকে করা হয়। ছোট দুইটি রাডার স্ক্রিনে দুই ধরনের বিষয় দেখার উপায় রাখা আছে। একটি স্ক্রিনে জাহাজের নিচে পানির গভীরতা পরিমাপ এবং যে কোন বস্তু, এমনকি ক্ষুদ্রাকৃতির মাছও, দেখতে পাওয়া যায়। অন্য স্ক্রিনে একটি নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি যাই থাকুক ধরা পরে। এই রাডারগুলো যে এ ধরনের শিপের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা বলাবাহুল্য।

‘এসিও লাগাইছেন দেখি’ – মনিরুজ্জামান স্যার পিছিয়ে পড়েছিলেন, এইমাত্র এসে ঢুকলেন নেভিগেশন রুমে।
জ্বি স্যার।
এসির দরকার কি? সাগরে কি বাতাসের অভাব?
কি যে বলেন স্যার! মালিক চাইল তাই লাগাইছে স্যার।
‘এইটা কি?’ – কাঠের সাথে কাঠ জোড়া দিয়ে বানানো হাতুড়ির মত একটা বস্তু হাতে তুলে নিলেন মনিরুজ্জামান স্যার।
‘এইটা বোধহয় ঠেক দেয়ার জন্য বানাইছিল স্যার। নতুন জাহাজ, এখনো সব ফেলা হয় নাই। এই এইটা নে স্যারের হাত থেকে।’
‘লাগবে না, থাক।’ দিলেন না মনিরুজ্জামান স্যার। বরং ওটা দিয়ে এদিক ওদিক ঠুকে দেখতে লাগলেন।
‘এটা কি কাঠের নাকি?’ একদিকের দেয়ালের দিকে ঠুকলেন তিনি।
জ্বি স্যার। বাহিরে স্টিল। ভেতরে কাঠ। ইনটেরিয়র ডিজাইন স্যার।
ভিতরে তো ফাঁপা মনে হচ্ছে না।
জ্বি না স্যার। ফাঁপা না। ফোম টাইপের জিনিস দিয়া ভর্তি করে দেয়া হইছে স্যার।
আবার কখন যাবেন চট্টগ্রাম?
মাল আনলোড হইলেই যাবো স্যার। সন্ধ্যার মধ্যে হয়ে গেলে ধরেন রাত নয়টা দশটার দিকে রওয়ানা করবো।

আমরা আরও কিছু সময় কাটিয়ে নেমে গেলাম এমভি ইহসান-১ থেকে। এবার যাবো থ্রি স্টার মেরিনের শিপইয়ার্ডে যেখানে এই জাহাজটার ক্লোন তৈরি হচ্ছে। মেঘনা ঘাটেই থ্রি স্টার মেরিনের প্রতিনিধি অপেক্ষা করছিলেন। বিশাল পেটের অধিকারী মোটাসোটা হাসিখুশি ভদ্রলোক তিনি। বললেন, তাদের কোম্পানির স্পিডবোট আসছে, সেটায় করে আমরা সরাসরি গিয়ে শিপইয়ার্ডে নামতে পারবো আর এতে সড়কপথে যাওয়ার তুলনায় সময় বাঁচবে প্রায় এক ঘন্টা।

মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির গোডাউন কারখানার সামনে থেকে আমরা স্পিডবোটে উঠলাম। সব মিলিয়ে দশজন বসার ব্যবস্থা। মাথার উপর ছাউনি। আমরা উঠে বসতেই স্পিডবোট হাই স্পিডে ছুটতে শুরু করলো। মেঘনা সেতুর নিচ দিয়ে বেড়িয়ে আমরা ছুটে চললাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার উদ্দেশ্যে। বামদিকে নদীর তীরে আরও কয়েকটি শিপইয়ার্ড চোখে পড়ল।

বাংলাদেশে শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি অনেক বিখ্যাত। সারা বিশ্বের বাতিল হয়ে যাওয়া মৃত শিপগুলা নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে। সেখানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বিষাক্ত শিপগুলো ভাঙ্গা হয়। সেই লোহালক্কড় যায় বিভিন্ন স্টিল মিলে আর সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিবছর নানা রকম দূর্ঘটনাও ঘটে আর পত্রিকার শিরোনাম হয়। কিছুদিন আলোচনা চলে তারপর যথারীতি সব স্তিমিত হয়ে পড়ে।

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের চেয়েও অনেক বেশি পুরাতন এদেশের জাহাজ নির্মান শিল্প। একসময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিও ছিল কিন্তু বর্তমানে দেশীয় লঞ্চ, কার্গো ইত্যাদি তৈরি আর মেরামতের মধ্যেই এদেশের জাহাজ শিল্প সীমাবদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কোম্পানী এগিয়ে এসেছে দেশি বিদেশি জাহাজ নির্মানে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম শোনা যায় আনন্দ শিপইয়ার্ড আর ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। আন্তর্জাতিক মানের শিপ বানাচ্ছে, শিপ রপ্তানি করছে – এমন বিভিন্ন সংবাদ দিয়ে কিছুদিন পরপরই শিরোনামে আসে ওয়েস্টার্ন মেরিন লিমিটেড। সরকারের বড় বড় মন্ত্রীরা বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। অথচ নির্মম বাস্তবতা হল ওয়েস্টার্ন মেরিন বাংলাদেশের শীর্ষ ঋণ খেলাপীর তালিকায় এগারো নম্বর

থ্রি স্টার মেরিন লিমিটেড এত বড় কোন প্রতিষ্ঠান নয়, তবে একদম ছোটও নয়। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি জাহাজের নকশা প্রণয়ন, নির্মান এবং রিপেয়ারের কাজ করে। এতদিন ভাড়াটে শিপইয়ার্ডে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও বছরখানেক আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় প্রায় ৫০০০ শতাংশ জায়গার উপরে নিজস্ব শিপইয়ার্ড গড়ে তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। ছোটখাটো বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ এর প্রধান ক্লায়েন্ট – পন্টুন, জাহাজ ইত্যাদি তৈরি ও মেরামতের সেবা প্রদান করছে থ্রি স্টার মেরিন।

প্রচুর কচুরিপানার মধ্য দিয়ে চালিয়ে যে বিশাল জাহাজটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আমাদের স্পিডবোটটা তার গায়ে নান লেখা ‘রুস্তম’। নামটা বহুল পরিচিত।

এটাই কি সেই রুস্তম নাকি?
জ্বি স্যার। আমাদের ডকে রিপেয়ার হচ্ছে এটা।

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি হামজা এবং রুস্তমের নাম। বাংলাদেশের উদ্ধারকারী জাহাজ। যখন কোন লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে, ডুবে যায় ইত্যাদি, তখন ডাক পরে এদের। লাশ উদ্ধার করে, ডুবে যাওয়া যান তুলে আনে।

প্রথমেই আমরা শিপইয়ার্ড দেখতে গেলাম। প্রচন্ড ধূলা বালুতে চোখ মুখ ঢেকে গেল। মাস্ক নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম। শিপইয়ার্ড এখনো নির্মানাধীন। বালু আর মাটি ফেলে প্রায় দশ ফুট উচু করা হয়েছে। আরও উচু করা হবে। তারপর প্রায় সম্পূর্ণ শিপইয়ার্ডটি হয়ে যাবে পাকা। তখন আর ধূলা-বালির এই সমস্যা থাকবে না – জানালেন কোম্পানীর প্রতিনিধি।

পাশাপাশি অনেকগুলো লোহার কঙ্কাল সাজানো – ওগুলো নির্মানাধীন পন্টুন। আর রয়েছে অনেকগুলো জাহাজের কঙ্কাল – কাঠামো। কোনটার কাজ শেষ পর্যায়ে, কোনটা মাঝ পর্যায়ে। এমভি ইহসান-২ এর কাঠামোর পাশে গিয়ে দাড়ালাম আমরা। নদীতে ভাসমান অবস্থায় জাহাজটাকে বড় বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এবার ডাঙ্গার উপর দেখার পর বুঝলাম জাহাজটা আরও বড়।

অবাক হচ্ছিলাম, নির্মানাধীন সকল জাহাজই খটখটে ডাঙ্গার উপরে। নদী যথেষ্ট দূরে রয়েছে। আগে যত শিপইয়ার্ড দেখেছি তার সবগুলোতেই রেলের পাত বসানো দেখেছি। শিপ নির্মান করার পর সেই রেল লাইনের উপর দিয়ে টেনে নামানো হয় নদীতে। এখানে সেরকম কিছুই নেই। তাহলে নির্মানের পর জাহাজকে পানিতে নামানো হয় কিভাবে?

প্রশ্ন করতেই থ্রি স্টার মেরিন কোম্পানীর প্রতিনিধি ভদ্রলোক বললেন, বেলুনের সাহায্যে। জাহাজ নির্মান হয়ে গেলে বেলুন সেট করা হয়। তারপর বেলুনে হাওয়া ভরলে জাহাজ হালকা হয়ে যায়, তখন সহজেই পানিতে নামানো যায়।

ভদ্রলোকের এত সরল ব্যাখ্যা আমি আরও সরলভাবে চিন্তা করলাম। বিশাল সব বেলুন জাহাজের বিভিন্ন প্রান্তে বেঁধে তারপর গ্যাস ভরে দেয়া হয়। এতে করে বেলুনগুলো উপরে উঠে যায়, আর টেনে তোলে জাহাজটাকে, তারপর জাস্ট টেনে নদী পর্যন্ত নিয়ে গেলেই হয়। এই চিন্তা যে কতটা অপরিপক্ক তা বুঝলাম ভদ্রলোক যখন মোবাইলে একটি জাহাজ পানিতে নামানোর পদ্ধতি দেখালেন। ইউটিউবের এই ভিডিও-তে আপনারাও দেখতে পারেন।

এক কোনায় সাইট অফিস। ভবনটাও নির্মাণাধীন। আমরা দোতালার একটি বড় রুমে বসলাম। রুমটার তিনদিকের দেয়াল নেই, খোলামেলা। বড় একটা তিনকোণা টেবিল রাখা আছে। আমরা ওখানে পৌছুতেই দুজন ভদ্রলোক আমাদের স্বাগত জানালেন।

আমি জাহিদুর রহমান। থ্রি স্টার মেরিনের জিএম। আর উনি সুমন রহমান, ইহসান শিপিং এর এমডি।
কি সুমন সাহেব, আপনার না মেঘনাঘাটে যাওয়ার কথা?
মেঘনা ঘাটেই যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জ্যামে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাই সরাসরি এখানে চলে এলাম।
আমি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। আর এ হল সুজাত আলী আর ও নাজমুল হাসান।
আপনাদের সাথে বোধহয় আগে দেখা হয় নি।
না। নাজমুল তো অল্প কিছুদিন আগে জয়েন করেছে। সুজাত ছিল ফরেন এক্সচেঞ্জে। আর আমি গত সপ্তাহে এই ব্রাঞ্চে জয়েন করলাম।
আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনার সাথে কি আগে দেখা হয়েছে?
হতে পারে। আমি বিবি এভিনিউ ব্রাঞ্চে এজিএম ছিলাম। তখন দেখা হতে পারে।
উহু। আমি বিবি এভিনিউর ক্লায়েন্ট ছিলাম না কখনো। বাইদ্যওয়ে, আসুন বসুন।

টেবিলের উপর নানা রকম খাবার সাজানো ছিল। কয়েক পদের বিস্কুট, কলা ইত্যাদি। একটা জগে গরুর দুধ। জানা গেল, শিপইয়ার্ডেই তারা চারটে গরু পোষেন, তার দুধ।

সুমন সাহেব, আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?
চলছে স্যার ভালোই। আপনাদের দোয়া।
ব্যাংকের টাকা তো দিচ্ছেন না।
মাঝে স্যার ব্যবসা ভালো যায় নি, আপনি তো জানেন। এই জাহাজটা গত বছর এপ্রিলে নামানোর কথা। নামল ফেব্রুয়ারিতে। এখন টাকা আসা শুরু হবে স্যার। এই শিপটা নেমে গেলেই আর সমস্যা থাকবে না স্যার। আর কয়েকটা মাস কেবল।
খুব হাইফাই শিপ বানিয়েছেন। ক্যাপ্টেনের ডেকে এসিও লাগাইছেন।
এটা স্যার, গরমের জন্য। আর এক মাস পরেই তো স্যার গরম শুরু হচ্ছে।
শিপে অন্য কিছু আনা নেয়া করেন না তো?
কি যে বলেন স্যার?
জাহিদ সাহেব, আপনারা যে ক্যাপ্টেন্স ডেকের দেয়ালে কাঠের ফলস দেয়ালটা লাগিয়েছেন, তার ভিতরে কি দিয়েছেন? এসবেস্টস?
না স্যার। ওগুলো ফাঁপা স্যার। শুধু শুধু খরচ বাড়িয়ে কি হবে স্যার।
কিন্তু আমার তো ফাঁপা মনে হল না। সুমন সাহেব?
আমি স্যার বুঝতে পারছি না। দেখতে হবে।
দেইখেন তো।

সুমন সাহেব এসময় উঠে ওয়াশ রুমে গেলেন। জাহিদ সাহেব গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন, স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে আমার ঠিক ব্যাংকার মনে হচ্ছে না।
কেন মনে হচ্ছে না জাহিদ সাহেব?
আমার ধারনা আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া ঠিক, তবে ব্যাংকার মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া নন।
ঠিক। আমি ব্যাংকার না, নারকোটিক্সের মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া।
আপনি কি স্যার আমাদের এরেস্ট করবেন?
আপনাদের না। সুমন সাহেবকে নিয়ে যাবো। উনার সাথে কথা আছে। নাজমুল সাহেব, আপনি দেখেন তো, উনি বাথরুম থেকে বের হয়েছেন কিনা।

আমি চট করে বাথরুমের দিকে চলে গেলাম। এই ফ্লোরে দুটো টয়লেট, দুটোই ফাঁকা। ওখানে কয়েকজন শ্রমিক আড্ডা দিচ্ছিল, তাদের কাছে জানতে চাইলাম টয়লেটে গেল যে স্যার তিনি কই। ওরা জানালো, ওদিকের সিড়ি দিয়ে তিনি নেমে গেছেন। আমি দৌড়ে টিমের কাছে ফিরে খবরটা দিলাম। মনিরুজ্জামান স্যার ধীরে সুস্থ্যে উঠে দাঁড়িয়ে সানগ্লাসটা চোখে পড়লেন, তারপর বললেন, কতদূর আর যাবে? চলি জাহিদ সাহেব।

আমার বেশ উত্তেজনা বোধ হচ্ছিল। পরিচয় গোপন করে এভাবে শিপইয়ার্ড দেখতে আসার পুরো ব্যাপারটাতেই খুব থ্রিল হচ্ছিল। মনে হচ্ছে, এখন একটা চেজ শুরু হবে। সুমন রহমানের পেছনে ভূঁইয়া স্যারের নেতৃত্বে আমরা। চাকরীতে ঢোকার পর থেকে ভূঁইয়া স্যারের কথা অনেকবার শুনেছি, আজ বোধহয় বাস্তবে দেখবো।

আমরা দ্রুত হেঁটে গিয়ে স্পিডবোটে উঠলাম। থ্রি স্টারের মোটাসোটা প্রতিনিধি ভদ্রলোক উঠতে গেলেন, ভূঁইয়া স্যার থামিয়ে দিলেন, আপনি উইঠেন না। দ্রুত যাওয়া দরকার।

স্পিডবোট ছেড়ে দিল। চালক ছেলেটা দক্ষতার সাথে কচুরীপানার ভেতর দিয়ে বোট চালিয়ে নদীতে নিয়ে এল। তারপর ছুটল নারায়নগঞ্জের দিকে। মিনিট পাঁচেক পরেই আমরা অন্য স্পিডবোটটা দেখতে পেলাম। ওটা নিশ্চয়ই শিপইয়ার্ড এর অন্য কোন দিকে বাঁধা ছিল।

স্পিডবোটটা ছুটছিল, কিন্তু সামনের স্পিডবোটকে ছুঁতে পারা ক্রমশই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ওটায় মানুষ মাত্র দুইজন, আমাদের এটায় ছয়জন। মনিরুজ্জামান স্যার এর মাঝেই এক জায়গায় ফোন করলেন, তারপর ইন্সট্রাকশন দিলেন মেঘনা ঘাটে নোঙর করা এমভি ইহসানের ক্যাপ্টেন্স ডেকে অভিযান চালাতে। তারপর আবার কল করলেন। বললেন, সুমন রহমান পালাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসি পার্কের ঘাট দিয়ে উঠবে সম্ভবত। লোক যেন তৈরি থাকে।

সূর্যটা ডুবে যাচ্ছিল। স্পিডবোট শীতলক্ষ্যা নদীতে ঢুকে পড়েছে। নদীর পানি কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্যটা ডুবে যাচ্ছিল নোঙর করা অনেক জাহাজ আর কলকারখানার ভেতরে। নদীর এই পাড়ে অনেক লোক বেড়াতে এসেছে। আমার মনে পড়ে গেল, আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস।

প্রায় আচমকাই বলা যায়, দেখলাম নদী ফুঁড়ে বিশাল এক নাগরদোলা বেরিয়ে এসেছে, ঘুরছে। যেন লন্ডন। নদীর তীরে এরকম একটি পার্ক আছে আগে জানা ছিল না। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বেশ সরগরম হয়ে আছে পার্কটা। একটি বড় ক্রুজ শিপও নোঙর করা আছে। ওটাই বিআইডব্লিউটিসি পার্ক, আগে নারায়নগঞ্জ ফ্যান্টাসি পার্ক নামে চিনতো লোকজন। ক্রুজ শিপটা একটা রেস্টুরেন্ট।

এই উত্তেজনার মাঝেও আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম একটা ড্রোন ক্যামেরা পানি ছুঁয়ে আমাদের স্পিডবোটের পিছু নিয়ে উড়ছে। তারপর ধীরে ধীরে বোট ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঠলে সুমন সাহেবের বোটটা পর্দায় ঢুকে পড়ল। তারপর আরেকটু উপরে উঠলে দেখা গেল দুটো স্পিডবোটই একটা পার্কের দিকে ছুটে চলছে, সেখানে রয়েছে বিশাল একটা নাগরদোলা আর শত শত মানুষ।

আমাদের গল্পটা এখানেই শেষ বলা যায়। সিনেমায় যেরকম হয়, পার্কের ভেতরে শত শত মানুষের ভেতর দিয়ে আমরা দৌড়াই নি, মনিরুজ্জামান স্যারও গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নি সুমন রহমানের উপর। আমরা পার্কের তীরে স্পিডবোট থেকে নেমে পার্কের ভেতর দিয়ে বাহিরে চলে এসে দেখলাম, সুমন রহমান একটা মাইক্রোবাসের ভেতরে বসে আছে। তার আশে পাশে ভূইঁয়া স্যারের লোকজন। ভূঁইয়া স্যার ইঙ্গিত দিলে গাড়িটি ছেড়ে দিল। আশেপাশের শত যাত্রী বুঝতেও পারল না কি ঘটেছে এখানে।

ঘন্টাখানেক পরে আমরা পুলিশ ব্রিফিং এর স্থানে উপস্থিত ছিলাম। এমভি ইহসানের গোপন প্রোকষ্ঠ থেকে আড়াই লক্ষ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে, তাই নিয়ে ব্রিফিং। সাংবাদিকরা যখন সুমন রহমান আর ইয়াবাসহ ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আমি তখন পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভূঁইয়া স্যার আমাকে ডাকলেন, ‘কি নাজমুল সাহেব। ছবি তুলতে চান নাকি?’
আমি লাজুক হেসে ‘জ্বি স্যার’ বললাম।
‘চলে আসেন। ছবি তুললে ছবি হতে সময় লাগবে না।’

গল্পের প্রয়োজনে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। সঙ্গতকারণেই এমভি ইহসানের ছবি দেয়া গেল না।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *