বটবৃক্ষ

বটবৃক্ষ

‘যে সময়ের কথা বলছি তখন সোনাপুর আর তামাবিলের মাঝে এরকম এক বিশাল বটবৃক্ষ ছিল’, এই বলে বুড়ো নাম্বি থেমে তার শ্রোতাদের দিকে তাকালো, তার আঙ্গুল বটবৃক্ষের দিকে।

বহু বছর বাদে আজ সন্ধ্যায় কাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে দেখল, বটবৃক্ষের কুলুঙ্গিতে আগুন বাতি জ্বলছে। এই আলোর একটাই মানে – বুড়ো নাম্বি আবারো গল্প বলবে! শেষবার নাম্বি দুইদিন ব্যর্থ চেষ্টার পর তৃতীয় দিন জানিয়েছিল, দেবী তার গল্প বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। সেই যে কথা বলা বন্ধ করেছিল নাম্বি, তারপর বললো আজ, মাঝে কত বছর পেরিয়েছে তার হিসাব কেউ রাখেনি।

‘তারও শত বছর আগে গাছটিও ছিল না, মাঝের বসতি তো হল এই সেদিন। সোনাপুর আর তামাবিলের মাঝে যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টের। খরা রোaদ আর ঝড়-বৃষ্টি – বিশ্রাম আর আশ্রয়ের কোন উপায় ছিল না। তাই কোন একদিন গ্রামের মুরুব্বিরা একত্রিত হয়ে পরামর্শ করে একটি বটের চারা লাগিয়ে দিলেন।’

‘দিনে দিনে সেই বটের চারা বড় হয়ে উঠল, ছড়িয়ে দিল ডালপালা আর শেকড়। বড় বড় সবুজ পাতা তৈরি করল ছায়া, গাছের ডালে বসে সেই ছায়ায় আশ্রয় নিতে আসল ছোট বড় পাখি আর দূর দূরান্তের পথিক নিচে বসে নিল বিশ্রাম। এভাবে ধীরে ধীরে এই বটের চারা হয়ে গেল বটবৃক্ষ। এইরকম’ – বলে যে বটগাছের নিচে বসে গল্প বলছিল সেই গাছকে নির্দেশ করল নাম্বি।

বটবৃক্ষ
বটবৃক্ষের বিস্তৃত ছায়া।

সবাই উন্মুখ হয়ে শুনছিল। তারা নাম্বির গল্প বলার পদ্ধতি সম্পর্কে জানে। বুঝতে পারে ভূমিকা শেষ হল, এইবার গল্পের ডালপালা বিস্তারের পালা।

‘এভাবেই চলছিল, বছরের পর বছর’, নাম্বি আবার শুরু করল। ‘কিন্তু একদিন একদিন কিছু পথিক গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারা দেখল, বটবৃক্ষের গোড়ায় মাটি কম, শেকড় দেখা যাচ্ছে। ‘দেখ, বৃষ্টির পানিতে মাটি ধুয়ে গেছে’, একজন বলল। ‘হ্যা, এভাবে চললে একদিন ছোটখাটো ঝড়েই এই গাছ উপরে যাবে’, বলল আরেকজন। তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল এই কথা, বটবৃক্ষ যে কোনদিন মুখ থুবড়ে পড়বে, তাই সাবধান!

যে মুরুব্বীরা বটের চারা লাগিয়েছিল তাদের বংশধরেরা একদিন একত্রিত হল। তারা অনেক পরামর্শ করল – কিভাবে বটবৃক্ষকে পতন থেকে রক্ষা করা যায়। কেউ বলল, গাছের গোড়ায় আরও মাটি দেয়া হোক, অন্যরা বলল, বৃষ্টিতে সেই মাটিও ধুয়ে যাবে। কেউ বলল, গাছের চারদিক বাঁধিয়ে দেয়া হোক, অন্যরা বলল, সে খুব ব্যয়বহুল। কেউ বলল, আরও বটের চারা লাগানো হোক, অন্যরা বলল, তা খুব সময়ের ব্যাপার। সঠিক কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পেরে তারা এই ব্যাপারে একমত হল, সোনাপুর আর তামাবিলের সবচেয়ে প্রবীণ আর অভিজ্ঞ লোকটির পরামর্শ গ্রহণ করবে তারা।

সব শুনে সেই প্রবীন লোকটি বলল, তোমরা ঠিকই বলেছো। বট খুবই উপকারী বটে, এর সমস্যাগুলোও এড়ানো যায় না। বটের ছায়ায় গাছ হয় না, আর তাই মাটিও ধুয়ে যায়। যদি বটকে রক্ষা করতে হয় তাহলে মাটি ধরে রাখতে হবে আর সেজন্য চাই গাছ।

কিন্তু বটের ছায়ায় যে গাছ হয় না? – সমস্বরে বলল সবাই।

‘হয়। তবে এজন্য বটের ডালপালা ছাটতে হবে, আলো-বাতাস আসতে দিতে হবে। তবেই বটের ছায়ায় নতুন গাছ হবে আর তাতে মাটি শক্ত হবে, বট বাঁচবে, ভবিষ্যতের ছায়াও নিশ্চিত হবে।’ এই কথা বলে প্রবীণ লোকটি তার খাটিয়ায় শুয়ে চোখ মুদলেন আর সকলে হাসিমুখে নিরবে প্রস্থান করলো।

‘এখন আর সেই বিশাল বটবৃক্ষ নেই কিন্তু আছে তার ছায়া, আরও বড় আকারে, আরও বেশি পথিকের জন্য।’ বুড়ো নাম্বি তার হাত তুলল, শ্রোতারা একে একে ফিরল। শেষ শ্রোতা চলে যাওয়ার সময় কুলুঙ্গিতে রাখা আগুনের বাতিটা নিভিয়ে দিল, নতুন গল্প তৈরি হলে এই বাতিটা আবারও জ্বলে উঠবে।

টীকা: আর কে নারায়ণ একটি গল্প লিখেছিলেন আন্ডার দ্য বেনিয়ান ট্রি শিরোনামে। এই গল্পের চরিত্র আর বর্ণনাভঙ্গি সেই গল্প থেকে ধারকৃত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *