তিন মাসে ঊনিশ ছবি, সফল হল কয়টি?

২০১৭ সালের তিনটি মাস শেষ হয়ে চতুর্থ মাস শুরু হয়েছে। এই তিন মাসের তের সপ্তাহে বাংলাদেশে মোট ঊনিশটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, অর্থ্যাৎ গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ছয়টি চলচ্চিত্র। সংখ্যার দিক থেকে ঊনিশটি চলচ্চিত্র একটি ইতিবাচক দিক, কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের বিবেচনায় এই সংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই ছবিগুলোর মাধ্যমে আয়ের সংখ্যা। দুঃখজনক ব্যাপার হল, আশাব্যঞ্জক কোন কিছু গত তিন মাসে পাওয়া যায়নি।

কাজী মারুফ অভিনীত রকিবুল আলম রকিব পরিচালিত চলচ্চিত্র মাস্তান ও পুলিশ চলচ্চিত্র মুক্তির মাধ্যমে ২০১৭ সালের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথম সপ্তাহে পঞ্চাশ বা এর কম-বেশি হলে মুক্তি পেয়েছে এমন চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে কত স্বপ্ন কত আশা, মায়াবিনী, প্রেমী ও প্রেমী, মিসড কল, ক্রাইম রোড, মেয়েটি এখন কোথায় যাবেভালোবাসা এমনই হয়, এবং সুলতানা বিবিয়ানা। হাতে গোনা কয়েকটি হলে প্রদর্শিত হয়েছে এমন চলচ্চিত্রের তালিকায় রিনা ব্রাউন, শেষ চুম্বন, ভুবন মাঝির নাম উপস্থাপন করা যাবে। প্রযোজক নির্ভর এবং সাধারণত একটি চলচ্চিত্রের পরই চলচ্চিত্রজগৎ থেকে হারিয়ে যান এমন শিল্পী নির্ভর চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে শূন্য, ভালোবাসা ১৬ আনা, সত্যিকারের মানুষ রিয়েল ম্যান এবং যে গল্পে ভালোবাসা নেই। নবাগত নির্মাতা মিজানুর রহমান লাবুর তিন মাসে দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। এদের একটি রোমান্টিক অ্যাকশন চলচ্চিত্র তুখোড় এবং অন্যটি রোমান্টিক ড্রামা নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার। এছাড়া নামকা-ওয়াস্তে যৌথ প্রযোজনার একটি চলচ্চিত্র হঠাৎ দেখা মুক্তি পেয়েছে যার মাধ্যমে একসময়কার জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন দীর্ঘদিন পর পর্দায় উপস্থিত হয়েছেন।

এই সকল চলচ্চিত্রের মধ্যে জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত এবং আরিফিন শুভনুসরাত ফারিয়া অভিনীত প্রেমী ও প্রেমী, শাহরিয়াজ-জলি অভিনীত নাদের চৌধুরীর চলচ্চিত্র মেয়েটি এখন কোথায় যাবে, এবং হিমেল আশরাফ পরিচালিত বাপ্পীআঁচল অভিনীত সুলতানা বিবিয়ানা তুলনামূলক ভালো ব্যবসা করবে এমন প্রত্যাশা করা হয়েছিল এবং এই ছবিগুলো মোটামুটি ব্যবসা করেছে। যেহেতু বাংলাদেশে বক্সঅফিস বলে কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই, তাই সত্যিকারভাবে এই ছবিগুলো কি পরিমান ব্যবসা করেছে তা জানা সম্ভব হয় না। একমাত্র সুলতানা বিবিয়ানা সম্পর্কে পরিবর্তন ডটকমের রিপোর্ট থেকে ভালো চলছে – এমন তথ্য জানা সম্ভব হয়।

ফাখরুল আরেফীন খান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ভুবন মাঝি নিয়ে দর্শকদের মাঝে বেশ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। সুঅভিনেতা হিসেবে পরিচিত কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশি সুঅভিনেত্রী অপর্ণার অভিনয়ে চমৎকার গল্পের একটি চলচ্চিত্র পাওয়া যাবে – এই প্রত্যাশা অবশ্য শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। পরিচালক ফাখরুল আরেফীন একটি ভিন্ন ধরনের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন এবং এ ধরনের প্রচেষ্টা সাদরে বরণীয়, কিন্তু দর্শককে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত করা সম্ভব না হলে অনেক যত্ন আর অর্থের বিনিময়ে নির্মিত চলচ্চিত্র মুখ থুবড়ে পড়ে এবং দর্শকের প্রত্যাশার পারদ নিম্নমুখী হয়।

হাসিবুর রেজা কল্লোল পরিচালিত দীর্ঘ প্রতিক্ষিত চলচ্চিত্র ‘সত্তা‘ মুক্তির মাধ্যমে চতুর্থ মাসের শুরু হয়েছে। সত্তা চলচ্চিত্রের শক্তিশালী দিক অনেকগুলো- এই ছবিতে বাংলাদেশের শাকিব খান এবং পশ্চিমবঙ্গের পাওলি দাম অভিনয় করেছেন। সাহিত্য থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের গানগুলো মুক্তির অনেক আগেই সমাদৃত হয়েছে। বিশেষ করে মমতাজের কন্ঠে গাওয়া ‘না জানি কোন অপরাধে’ – গানটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এ সকল ভালো দিক থাকা সত্বেও সত্তা খুব বেশি হলে মুক্তি পায়নি। কলকাতার চলচ্চিত্র হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা যা মুক্তি পেয়েছে আরও তিন মাস আগে, যা ইউটিউবে সহজলভ্য এবং এ সপ্তাহেই স্টার জলসা চ্যানেলে প্রদর্শিত হবে, সেই ছবিটি একসাথে ৭৯টি হলে মুক্তি পেয়েছে। আগামী সপ্তাহে মুক্তি পাবে জাজ মাল্টিমিডিয়া এবং এসকে মুভিজের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ধ্যাততেরিকি। শোনা যাচ্ছে শাকিবের আরেক ছবি অহংকার মুক্তি পাবে। ফলে, সত্তা সত্যিই কতটুকু ব্যবসা সফল হবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে, এর সত্যতা যাচাই করা যাবে দুই সপ্তাহ পরে।

সুলতানা বিবিয়ানা ট্রেলার

কেবলমাত্র আয়ের উপর নির্ভর করে চলচ্চিত্রকে সফল বা ব্যর্থ বলা অনুচিত। গত তিন মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এক চতুর্থাংশ চলচ্চিত্রেই মৌলিক গল্প বলার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন যেখানে নকলপ্রবণতা চরমে, সেখানে এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। ভালো গল্পের পাশাপাশি ভালো অভিনয়ও পাওয়া যায় এমন চলচ্চিত্র গত তিন মাসে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু দিন শেষে বাংলাদেশের মত রুগ্ন চলচ্চিত্রশিল্পে অর্থের অঙ্কে ব্যবসার সফলতা মাপতেই হয়। চলচ্চিত্রে ভালো গল্প যত ভালোভাবেই বলা হোক না কেন, পুঁজি ফেরত আনতে সক্ষম না হলে এ শিল্প নির্মাণের গতিধারা থেমে যেতে বাধ্য।

এক মাসে কতটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া উচিত – এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। বিএমডিবি-র পাঠকদের কাছে আমরা এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। ‘এক মাসে সর্বোচ্চ কতটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া উচিত বলে মনে করেন?’ – এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায় ৫৮ শতাংশ দর্শক মনে করেন মাসে সর্বোচ্চ চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক। অবশ্য, এদের প্রায় সমসংখ্যকত দর্শক (৪২ শতাংশ) মনে করেন, প্রতিমাসে কমপক্ষে চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া উচিত। সকলের জন্য উন্মুক্ত এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মাত্র ৬১টি জন দর্শক। কোন সিদ্ধান্ত টানার জন্য এই সংখ্যা খুবই দুর্বল, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে যদি শতকরা ৪৩ জন দর্শক মাসে চারটির বেশি চলচ্চিত্র প্রত্যাশা করেন তবে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতি কেন হচ্ছে না – তা নিয়ে জরুরিভাবে গবেষণা শুরু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, দেশের সীমিত সংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে সারা বছরে কি পরিমান চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া হলে অধিকাংশ চলচ্চিত্রের পুঁজি ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে এবং শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র নিজ পায়ে দন্ডায়মান হতে সক্ষম হবে সে বিষয়টি সম্পর্কেও গবেষণা হতে পারে।

বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি)-তে প্রকাশিত

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *