কৈশোরে ফেরা

দুম করে অনেক বছর আগে ফিরে গেলাম। এত সহজে ফিরে যেতে পারবো ধারণা ছিল না, তাই বেশ উত্তেজিত। উত্তেজনার বহি:প্রকাশ এই ব্লগ।

বছর বারো পনেরো আগে বই পড়তাম হাভাতের মত। তখন কম্পিউটার ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না। এমনকি বাসায় ইচ্ছেমত সিনেমা দেখারও কোন মাধ্যম ছিল না। বাহিরে খেলাধূলার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিল। ইন্ডোর গেমস তেমন একটা জমতো না। ফলে বইয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কোন একটা বই পড়া শুরু হলে অন্য দিকে মনযোগ দেয়ার সুযোগ পাওয়া যেত না, ইচ্ছেও করতো না। সারি ধরে বইয়েরা অপেক্ষা করতো – একটি পড়া শেষ হলেই আরেকটির শুরু। এখন আর সেই সুযোগ হয় না। কম্পিউটার সারাদিন দখল করে রাখে, বই পড়া হয় মোবাইলে, তাও রাস্তায়। এক বই পড়তে সময় লেগে যায় মাসখানেক বা তারও বেশি। পড়তে হবে এমন বইয়ের তালিকা বড় হতেই থাকে। কিন্তু বহু বছর বাদে সেই পুরানো ঘটনাই ঘটল এই কদিন।

টরেন্ট সাইটে ঘোরাঘুরি করতে করতে এক ফোল্ডারে ত্রিশটি ওয়েস্টার্ন বই পাওয়া গেল হটাৎ।  তার প্রথম বই ‘আবার এরফান’। নাম দেখেই আমার মনে পড়ে গেল দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে রাখা কয়েন  ড্র করে উড়িয়ে দেয়ার ঘটনা। এরফান জেসাপ – আমার সবচেয়ে পছন্দের নায়ক। সেবা প্রকাশনীর নিরানব্বই ভাগ গল্পই কোন না কোন গল্প/উপন্যাস বা সিনেমা থেকে নেয়া। এরফান জেসাপ কোন সিনেমা থেকে নেয়া সেটা জানার ইচ্ছে থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম – কিন্তু কোন সিনেমার নাম পাওয়া গেল না। এদিকে লোভও সামলাতে পারছি না, তাই আবার এরফান পড়া শুরু করলাম। ওয়েবে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম এরফান জেসাপের প্রথম উপন্যাসের নাম আলেয়ার পিছে, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই সেবার ওয়েস্টার্ন সিরিজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আফসোসের বিষয় হল আবার এরফান, অ্যারিজোনায় এরফান এবং মৃত্যুমুখে এরফান ছাড়া আমার আর কিছু পড়া নাই। ডেথসিটি পড়েছি কিনা তা মনে করতে পারি না। ফলে আবার এরফান পড়া শুরু হল, শুরু হল রুদ্ধশ্বাস যাত্রা।

ডাবল বার র‍্যাঞ্চের ফাইভের বিরোধ বহুদিনের। এরফান যেদিন ডাবল বারে যোগ দিল সেদিনই মারা পড়ল তার মালিক, গোলমালও বাড়ল। হটাৎ আবিস্কৃত হল দুটো র‍্যাঞ্চই দেনায় জর্জরিত, মর্টগেজের টাকা না পরিশোধ করতে পারলে নিলামে উঠবে। তাই দুই দলই ছুটল গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য – এই হল আবার এরফানের কাহিনী।

আলেয়ার পিছে নামিয়ে রেখেছি আগেই, একই ভলিউমে আছে আর কতদূর! আবার এরফান পড়া শেষ করেই আলেয়ার পিছে শুরু করলাম। এই উপন্যাসেই এরফান এবং তার প্রেমিকা, পরবর্তিতে বউ, রাকা ওয়েস্টের সাথে পরিচয়, প্রণয়ের সূত্রপাত ঘটে। সব গুটিয়ে নিয়ে দূরের এক জায়গায় নতুন বসতি স্থাপন করতে চলছে কতগুলো মানুষ। তাদের সাথে আছে কতগুলো কুখ্যাত মানুষও, যাদের মতলব মোটেই পরিষ্কার নয়। ফলে আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেল এরফান জেসাপও। প্রথম বই বলে এখানে এরফান জেসাপের একটা পরিচয়ও দেয়ার চেষ্টা করা করা হয়েছে। মাসুদ রানা তখন বেশ জনপ্রিয়, ফলে এরফান জেসাপের চিত্রায়নের সময়ও একই টেকনিক ফলো করার চেষ্টা করেছিল লেখক কাজী মাহবুব হোসেন, এরফান হোসেনের পূর্বপুরুষকে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু পরে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন এটা না করলেই ভালো, কারণ পরে আর এই বিষয় টেনে আনেননি।

আর কতদূর বইয়ের শুরুতেই জিম জেসাপের নাম। কাহিনীও তাকে ঘিরে। এরফান জেসাপের নাম না পেয়ে আগ্রহ হারিয়েই ফেলেছিলাম, কিন্তু অন্য এক তালিকায় দেখলাম এটিও এরফান জেসাপের বই। অগত্যা ফিরলাম। এরফান জেসাপ থাকলেও এই বইয়ে তার ভূমিকা কম, সাত বছরের জিম জেসাপের অভিযানেরই গল্প। দূরে চাচার কাছে গিয়েছিল সে, ফেরার সময় ইন্ডিয়ান আক্রমণে জিম আর তার চাচাতো বোন দুই বছরের লিয়া বাদে সকলেই মারা পড়ে। বিগ রেড নামে বিশাল এক স্ট্যালিয়নে চড়ে তারা পাড়ি দিতে শুরু করলো দুর্গম পথ। ঘোড়ার লোভে পেছনে লাগল ইন্ডিয়ান আর আউটল, আরো আছে বিরূপ প্রকৃতি, জন্তু জানোয়ার। যে রসের জন্য ওয়েস্টার্ন বই পড়া তা পাওয়া গেল না, তবে গল্প গতিহীন নয় বলে পড়া থামাতেও হল না।

তালিকায় বলা ছিল ভূমিগ্রাস এরফান জেসাপের বই। সে কারনেই ডাউনলোড করে নেয়া। পড়তে গিয়ে দেখা গেল এরফান জেসাপের নাম গন্ধও নেই। ক্লিন্ট হেডেন হল গল্পের নায়ক যে কিনা জেল খেটে বের হয়ে এসেছে। এরফান জেসাপ নেই বলে পড়া বন্ধ করে দেয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল দুটি পাতা নেই। ইগনোর করে কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল আবার দুটো পেজ নাই। এবার পুরো বইটা একনজর দেখতে গিয়ে দেখা গেল এই পেজ মিসিং এর ঘটনা একটু পর পরই ঘটেছে। ফলে বাদ দিতেই হল।

কেউ একজন, সে খুবই ফালতু, গণহারে পোস্ট দিয়ে জানালো সাইকো নামের বইয়ের এক অংশ থেকেই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার সিনেমার গল্প নেয়া হয়েছে। পড়তে গিয়ে দেখা গেল আলফ্রেড হিচককের সাইকো সিনেমার গল্পের একটা অংশ এই বই থেকে নেয়া। কাহিনীর প্রেক্ষাপট সেই ষাটের দশকে। অফিসের টাকা চুরি করে প্রেমিকের কাছে পালিয়ে যাবার পথে খুন হয়ে গেল এক তরুণী, নিখোঁজ বোনকে খুঁজে বের করতে হাজির হল তার ছোট বোন। গল্প খুবই ছোট, মাংসের পরিমান বেশী। তবে খুবই সুস্বাদু। অনুবাদ করেছেন অনীশ দাস অপু – একসময় তাকে হরর গল্প লেখক হিসেবেই চিনতাম, অনুবাদক হিসেবেও ভালো লাগলো।

এখন হাতে আছে সাম্ভালা সমগ্র। এই বইয়ের জন্য আগ্রহ পুষে রেখেছিলাম বই প্রকাশের সময় থেকেই। মৌলিক বাংলাদেশি থ্রিলার – আগ্রহটা একটু বেশী, কিন্তু বই পড়ার কারণে আটকে যাওয়া কাজগুলো চাপ দিতে শুরু করেছে। শৈশবের দিন বোধহয় আবারো ফুরালো।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *