সাক্ষাতকারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

b3b15df6739406f49ce254a3c3427c49-25

দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একটা হাস্যকর মজার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে হয়তো কেউ কিছু বলেছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, ‘অমুকের সাথে (পত্রিকার নাম) এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন’। ভাব দেখে মনে হয়, সাক্ষাতকার যেন শুধু তাকেই দেয়া হয়েছে। আরও মজার ব্যাপার হল – তারা বলেন এক কথা কিন্তু পত্রিকাগুলো সেগুলো নিজের ভাষায় কিছু কাটছাট করে বা বাড়িয়ে লেখার ফলে দুটো পত্রিকায় দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। এরকম ক্ষেত্রে পাঠকের বাধ্য হয়ে একাধিক পত্রিকা পড়ার কোন বিকল্প থাকে না।

কিছুক্ষন আগে আমিও তাই করেছি। পশ্চিমবাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় চট্টগ্রাম এসেছিলেন গতকাল, বাতিঘর প্রকাশনীর একটি অনুষ্ঠানে তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তার বক্তব্য নিয়ে আজ পত্রিকাগুলো রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তিনি আসলে কি বলেছিলেন – কয়েকটা পত্রিকা ঘেটে সেটা বের করার চেষ্টা করেছি।

প্রথম লেখালিখি প্রসঙ্গে বলেছেন –

২২-২৩ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু। মনে পড়ে প্রথম দু’বার লেখা ফেরত এসেছিল দেশ পত্রিকা থেকে। তারপর তৃতীয় গল্পটি ছাপা হলো। ব্যস্‌ সেই থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল সে লেখাটি। ভেবেছিলাম আর ছাপাই হবে না। সালটা ছিল ১৯৫৮। দেশ পত্রিকায় তখন একটা লেখা ছাপা হওয়া মানে রাতারাতি লেখক বনে যাওয়া। আমি ধৈর্য হারাইনি। লিখে গিয়েছি সমান তালে। তারপর বেরোলো ‘ঘুনপোকা’ উপন্যাস। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। কেউ নিন্দাও করছে না, প্রশংসাও না। ভাবলাম কেউ উল্টেপাল্টে দেখেনি। অথচ ৪০-৪৫ বছর পরও এখন বছরে একটি এডিশন বেরোয়। ‘দূরবীন’ লেখার সময়ও তা ভেবেছিলাম। দীর্ঘ ন্যারেশন। বিরক্তিকর। কিন্তু সেটিও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। লেখার সময় আমি আসলে বুঝতে পারি না কি লিখছি কিংবা কোথায় গিয়ে ঠেকছে আমার গল্পটি।

দূরবীন প্রসঙ্গে বলেছেন –

“এটাতে আমি ৫০ বছর আগের এবং পরের ভাবনা আনার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় নিজের কাছেই কিছু কিছু অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কিন্তু দেখি পাঠক ভালোভাবে নিয়েছে।”

লিখালিখি প্রসঙ্গে বলেছেন –

“লেখাটা পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। কলম ধরলেই লেখা বেরোয় না। বড়শিতে মাছ ধরার মতো। শব্দ কখন ঠোকর মারবে, সে অপেক্ষা করতে হয়। আমি জনপ্রিয়তা বা পয়সার জন্য লিখি না। নিজের যা মনে এসেছে তাই লিখেছি। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বা পয়সা আমাকে বরণ করেছে।”

তার গল্পে ট্রাজেডির উপস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন –

“আমার গল্পে খুব একটা ট্রাজেডি নেই। অসংখ্যবার এ বিষয় নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি জানি বাঙালী ট্রাজেডি ভালোবাসে, কিন্তু আমার দেখাতে ইচ্ছে করে না। নিরানন্দকে আমি পাঠকদের মধ্যে সঞ্চার করতে চাইনি।”

শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বলেছেন –

“সন্দেহ নেই যে শরৎচন্দ্র অনেক মহৎ লেখক,।কিন্তু কোথায় থামতে হবে তা তিনি জানতেন না। যার কারণে পাঠককে বালতি বালতি চোখের জল ফেলতে হয়েছে।”

নিজ সম্পর্কে বলেন –

“আমি দুর্বল ও কিছুটা ভীতু। পালিয়ে গেলেই বাঁচি এমন একটা স্বভাব রয়েছে নিজের মধ্যে। নিজে সবসময় সমাজ মুক্তি নিয়ে চিন্তা করি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। সুনীল আমার প্রিয় বন্ধু। তার লেখার অনেক পাঠক আছে। সে আর আমি মিলে যখন আড্ডা দিই তখন বাইরের অনেক মানুষ মনে করে নিশ্চয় দুইয়ে মিলে কিছু হচ্ছে। আসলে তখন আমরা আড্ডা দিচ্ছি কলকাতার কোন গল্পের সুন্দরী নায়িকার চুল কিংবা অবয়ব নিয়ে (হাসি)। এই হচ্ছি আমি। কিছুটা আড্ডা দিই। কিছুটা চুপচাপ। কিছুটা বাস্তববাদী।”

প্রেম সম্পর্কে বলেছেন –

“আমি আপাদমস্তক জিরো। বাড়ির গুরুজনরা বলতেন, ছেলের বয়স হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। কখনো মা বলতো, ও করবে বিয়ে। তাহলে হয়েছে। সত্যি বলতে কি। সুন্দরী মেয়েদের দেখলে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। কারণ মনে হতো কি থেকে কি হয়ে যায়! প্রেমের ব্যাপারে ভীতু ছিলাম। এটা এখনও বলি। আমাকে যে নারী বিয়ে করেছে সে ভুল করেই করেছে বলে মনে হয়। প্রেমের বিষয়টি সারাজীবন আমার কাছে আঙুর ফল টকের মতো।”

জীবনের হতাশা এবং ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলেছেন –

“ছেলেবেলা ছিল যাযাবরের মতো। ফলে বিচিত্র নতুনত্ব আমার জীবনে সম্পৃক্ত হয়েছে। জীবনে যন্ত্রণা থাকলে মৃত্যুচিন্তা আসবে। জীবনে একাধিকবার মানসিক অবসাদ ও আÍপরিচয় সংকটে পড়ে একটা সময় পৃথিবীতে না থাকার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই অদ্ভুত ভয়ংকর মানসিক অবসাদ আমাকে বিহ্বল করে দিত। বেঁচে থাকা ছাইমাটির মতো মনে হতো। আত্মপরিচয় সংকট বা আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগতাম। মহাকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, অসীমের শেষ নেই। এক সময় মনে হল, অসীমকে ধারণা করতে গেলে পাগল হতে হবে। আজ অবধি মানুষ মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে জানে না। মৃত্যুর পর মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ জানে না। এই সব প্রশ্ন আমায় তাড়া করতো। প্রশ্নগুলো আমাকে এতটাই যন্ত্রণা দিতো যে আমি মায়ের কাছে গিয়ে মাথা চেপে ধরতাম। এসব সমস্যা অনেক বার হয়েছে। এ যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমনো হয়েছে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি আর থাকবো না। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এ চিন্তার সময় আমি ঠাকুরের (অনুকূল চন্দ্র) কাছে যাই। তিনি আমার অবসাদ দূর করে দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম জীবনের খেলা শেষ না করেই আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। ওই সময় কেউ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে যেন বললো, গো অ্যান্ড সি দ্য লাইফ অ্যাগেইন।”

বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছেন –

“বাংলাদেশের মানুষ ভীষণরকম সাহিত্যপাগল। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ আছেন, সেখানেও এমনটি দেখেছি। বাংলাদেশ আমাদের আশার আলো। এখানে বাংলা সাইনবোর্ড দেখে আমি আনন্দিত হই। বাংলাদেশের কারণে বাংলা একটি রাষ্ট্র ভাষা এটি কম নয়। বাংলাদেশ আমার নিজেরই দেশ। এখানে জন্মেছি আমি। পূর্বপুরুষের বাস এখানে। চলে যেতে হয়েছিল। এদেশ ছেড়ে গেলেও কোন এক অদ্ভুত টান আমাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে এখানে। কারণ এখানেই আমার জন্ম হয়েছে। বেড়ে উঠেছি বাংলাদেশের আলো বাতাসে। প্রিয় জন্মভূমিকে কখনও কি ভোলা যায়? এদেশকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এখনও আমাকে কুরে কুরে খায়। এ মুহূর্তে একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। যখন আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন একটা পিঁপড়ে আমার পায়ে কামড় দিয়েছিল। সে কামড়ের যন্ত্রণা আমাকে দেশ ভাগের ব্যথায় নিয়ে যায়। বুঝতেই পারছেন বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটা সেদিন কিভাবে উপলব্ধি হয়েছিল। এ মাটিতে পূর্বপুরুষদের দেহাবশেষ মিশে আছে। “

সূত্র: মানবজমিন, প্রথম আলো, বাংলানিউজ২৪, যুগান্তর
ছবি: প্রথম আলো

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *