“হে আল্লাহ! তুমি যে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছো আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি!”
দুই হাত উপরে তুলে তিনি এই দোয়া করলেন। তার স্থির বিশ্বাস – সাত আসমান উপরে আরশে বসে আছেন যিনি, তিনি অবশ্যই তার এই দুয়া কবুল করবেন। ক্ষুদ্র একটি বাহিনী নিয়ে তিনি এসেছেন লড়াই করতে – মাত্র তিনশত তেরো জন প্রায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ করতে এসেছেন পায়ে হেঁটে। তিনশ লোকের জন্য বাহন বলতে দুটো ঘোড়া আর গোটা সত্তর উট। প্রত্যেকটা উটে পালা করে তিনজন সওয়ারী হচ্ছেন। বাহন নেই, ভালো অস্ত্র-শস্ত্র নেই, পর্যাপ্ত খাবার নেই – কিন্তু তারা একত্রিত হয়েছেন তাঁর নেতৃত্বে, এসেছেন বিজয়ী বেশে ফিরে যাওয়ার জন্য – সেই বিজয় যার প্রতিশ্রুতি মহান রাব্বুল আলামীন দিয়েছেন।
ঠিক যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা এই প্রান্তরে একত্রিত হন নি। অল্প কিছুদিন আগেই তারা তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। তাদের বাড়ী-ঘর, সহায় সম্পত্তি লুটপাট হয়ে গিয়েছে। সেই লুটপাট হয়ে যাওয়া সম্পদের অর্থে কেনা পন্যদ্রব্য নিয়ে শ্যাম প্রদেশ থেকে ফিরছে যে ব্যক্তি তার নাম আবু সুফিয়ান। তারা এসেছিলেন আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে সেই পন্যদ্রব্য আদায় করে নিতে। কিন্তু আবু সুফিয়ানের সংবাদ পেয়ে উট-ঘোড়ায় চেপে ছুটে এসেছে এক হাজার সশস্ত্র ব্যক্তি। তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত – তাদের আছে বাহন, তাদের আছে অস্ত্র-শস্ত্র, তাদের আছে খাবার এবং তাদের মধ্যে আছে তীব্র ঘৃণা। তারা শুধু আবু সুফিয়ানকে উদ্ধার করে নিতে আসে নি, তারা এসেছে এই প্রান্তরের অপর প্রান্তে দাড়িয়ে থাকা যে তিনশ মানুষ, তাদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তারা শুধু লড়াইয়ে জিততে চায় না, তারা চায় পৃথিবী থেকে এদের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলতে। আজই হবে সেই দিন।
অথচ বিপরীত প্রান্তে মাত্র তিনশত তেরোজন মানুষের নেতা শান্ত-নির্লিপ্ত মুখে হাত তুলেছেন স্রষ্টার কাছে। তিনি সাহায্য চাচ্ছেন, তিনি বিজয় চাচ্ছেন – সেই বিজয় যার প্রতিশ্রুতি তিনি পেয়েছেন স্রষ্টার কাছ থেকে। তিনি বলছেন –
“হে আল্লাহ! অহংকারী এবং উদ্ধত কুরাইশরা তোমাকে অস্বীকার করে এবং তোমার দূতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে এখানে হাজির হয়েছে। হে আল্লাহ! তুমি যে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছো আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি! আমি জোর দাবী জানাচ্ছি আল্লাহ তুমি তাদের পরাজিত করে দাও। হে আল্লাহ! যদি ক্ষুদ্র এ দলটি আজ শেষ হয়ে যায়, তবে পৃথিবীতে তোমার নাম নেওয়ার মতো আর কেউ থাকবে না!”
তিনি কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনার সময় তার আলখেল্লাটি কাঁধ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। পাশে দাড়িয়ে ছিল তার আবাল্য বন্ধু সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীটি। আলখেল্লাটি মাটি থেকে তুলে আবার কাঁধে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, “আপনি আপনার রবের দরবারে অনেক কেঁদেছেন। তিনি অবশ্যই তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন।”< যিনি বললেন তার নাম আবু বকর সিদ্দিক (রা) – খলিফাতুর রাসুলুল্লাহ। আর যাকে বললেন তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, বিপথগামী মানবতার জন্য প্রেরিত পথপ্রদর্শক, শান্তির দূত হযরত মোহাম্মদ (স)। যে প্রান্তরে দাড়িয়ে প্রায় তিনগুন বেশী সংখ্যক সশস্ত্র যোদ্ধার বিপক্ষে বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করছেন তাঁরা – তার নাম বদর প্রান্তর!
আমি বলছি ১৪৩৩ বছর আগের ঘটনা। আমি বলছি বদর যুদ্ধের ঘটনা। আমি বলছি ১৭ই রমজানের ঘটনা।
দোয়ার জবাব পাওয়া গেল সাথে সাথেই। মহান রাব্বুল আলামীন জানিয়ে দিলেন, “আমি তোমাদের সাথে রয়েছি, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের অবিচলিত রাখো। আর আমি কাফেরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করে দেবো।” (সূরা আনফাল: ১২)
তিনি সাহায্য পাঠাবার প্রতিশ্রুতিও করলেন। বললেন, “আমি তোমাদের সাহায্য করবো একের পর এক হাজার ফেরেশতার মাধ্যমে।” (সূরা আনফাল: ৮)
আনন্দের আতিশয্যে রাসূলুল্লাহ (স) কেঁদে ফেললেন, বললেন, “আবু বকর (রা)! সুসংবাদ! আল্লাহর বিজয় এসে গেছে! By Allah, I can see Jibreel on his mare in the thick of a sandstorm.”
জিবরাঈল (আ) এসে রাসুলুল্লাহ (স) কে পরামর্শ দিলেন, রাসুলুল্লাহ (স) সেই মোতাবেক একমুঠো বালি এবং মাটি নিয়ে ছুড়ে দিলেন শত্রুপক্ষের দিকে, বললেন – “Confusion Seize their faces.” সাথে সাথে এক ভয়ংকর বালিঝড় শত্রুপক্ষের দিকে তাড়া করল। আল্লাহ বলেছেন, “মাটির মুষ্ঠি তুমি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং যেন ঈমানদারদের প্রতি তিনি এহসান করতে পারেন যথার্থভাবে।” (সূরা আনফাল: ১৭)
তারপর রাসুলুল্লাহ (স) এর নেতৃত্বে মুষ্টিমেয় দলটি দৃপ্তপ্রত্যয়ে ঢুকে গেলেন লড়াইয়ে। তীব্র সে লড়াই, সত্য মিথ্যার লড়াই। সেই লড়াই যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেছেন। “তোমরা (মুসলমানরা) তাদের হত্যা করো নি, বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছেন।” (সূরা আনফাল: ১৭)
লড়াই শেষ হয়ে গেল। কুরাইশরা পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে গেল বদর ময়দান থেকে। তাদের সত্তর জন নিহত হল, বন্দী হল আরও সত্তর জন। অন্যদিকে বিজয়ী মুসলমানদের মধ্য থেকে ১৪ জন সাহাবী পান করলেন শাহাদাতের অমৃত পেয়ালা। সত্য এবং মিথ্যার লড়াইয়ে বিজয়ী হল সত্য – যার বিজয়ের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তায়ালা দিয়েছিলেন। মিথ্যার বিপরীতে যার জয় সবসময়েই সুনিশ্চিত।
আজ সেই সতেরই রমজান। আজ বদর দিবস!