ভালোবাসায় শাস্তি শাস্তি খেলা

দরজা খুলতেই রিমা বলল, ‘তোর বাসায় আজকের রাতটা থাকবো। সমস্যা থাকলে বলে ফ্যাল, দরজা থেকেই বিদায় নেই’।

রিমা কেন আমার বাসায় রাত থাকতে চায় সে কারণ আমি আন্দাজ করতে পারি তারপরও জিজ্ঞাসা করতে হয়, তাই জানতে চাইলাম – থাকতে চাস, থাকবি! কিন্তু তোর রিকশাওয়ালা জামাই কই? এখনো সদরঘাটে ট্রিপ দিচ্ছে নাকি? রিমা পাত্তা না দিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে গেস্টরুমে চলে গেল। ‘রিকশাওয়ালা ঝগড়া করছে আমার সাথে, আজকে তার পানিশমেন্ট নাইট’।

রিমার এই পানিশমেন্ট কনসেপ্টের সাথে আমার পরিচয় নতুন নয়। বিয়ে করেছে বছরখানেক হয়েছে, প্রথম মাস থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে মন কষাকষি, রাগারাগির পানিশমেন্ট দেয়ার জন্য আমার বাসা সে ব্যবহার করছে। ইস্যুগুলো যে খুব গুরুতর তা না। হয়তো কোন একটা কথায় হঠাৎ আহত বোধ করে কিংবা রিমার দিকে কিছু সময় মনযোগ না দেয়ার অভিমানে রিমা আমার বাসায় চলে এসেছে শাস্তি দেয়ার অভিপ্রায়ে। ঘন্টাখানেক থেকে শুরু করে একদিনের ব্যবধানে সেই শাস্তি শেষও হয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রিমার বর আপোষে রফা করেছে, কখনো কখনো রিমা নিজেই শাস্তি মওকুফ করে দিয়েছে।

প্রথম দিকের ঘটনাগুলো দারুন ছিল। রিমা বাসায় এসে হাজির হওয়ার পর থেকেই আমার মোবাইলে কলের পর কল আসতে থাকতো। ‘ভাইয়া, কাইন্ডলি ফোনটা রিমাকে একটু দেন না, সে আমার কল ধরছে না’, ‘ভাইয়া, রিমাকে একটু বোঝান না’, ‘ভাইয়া, রিমাকে বলেন আমি এক্সট্রিমলি স্যরি’, ‘ভাইয়া, রিমাকে বলেন তার দাবী গ্রান্টেড’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মোবাইলে কল দেয়ার পরেও অবশ্য তার তর সইতো না – সিএনজি নিয়ে হাজির হত ঘন্টাখানেকের মধ্যে। সিএনজি দাড় করিয়ে রেখে আমার বাসায় হাজির হতেই রিমা হাসিমুখে তার সাথে বের হয়ে যেত। কখনো কখনো হয়তো গেস্টরুমের দরজা বন্ধ করে দশ পনেরো মিনিটের বিচারকার্য, তারপর হাস্যমুখে দুজনের প্রস্থান।

সবদিন যে ঘন্টাখানেকের মাঝে শাস্তিপূরণ হয় তা কিন্তু নয়। শেষবারের ঘটনায় পুরো একদিন সময় লেগে গিয়েছিল। যে ছেলে এক ঘন্টায় ত্রিশ চল্লিশবার ফোন দিতে পারে সেই ছেলেই সারাদিনে কোন ফোন দিল না। রাত দশটার দিকে রিকশা নিয়ে এসে রিমাকে নিয়ে গেল সে, কৃত্রিম হাসিতে বলে গেল – ‘ভাইয়া অনেকদিন আমাদের বাসায় যাচ্ছেন না কিন্তু, আগামী শুক্রবার অবশ্যই আসবেন। দুপুরে খাবেন আমাদের সাথে, ওকে?’ আমিও কৃত্রিম হাসিতে বলেছি – ‘অবশ্যই অবশ্যই। কিন্তু সেদিন আবার তোমাদের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেবে নাতো?’।

রিমার এই পানিশমেন্ট টেন্ডেন্সি আমাকে মাঝে মাঝে ভাবায়। প্রেমিক জুটির মধ্যকার এই মন কষাকষি, অপরাধ-বিচার-শাস্তি-আপোষ দুজনের সম্পর্ককে মজবুত করে তোলে। দুর্যোগের এই অধ্যায়ের পরের অধ্যায় যে অত্যন্ত মধুর তা ব্যাখ্যা করে বলতে হয় না। কিন্তু শঙ্কাও তো জাগে!  যে ভালোবাসার অধিকারে রিমা তার জামাইকে শাস্তি দেয় এবং জামাই ভালোবাসার টানে ছুটে আসে রিমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সেই ভালোবাসার জায়গায় যদি কখনো বিরক্তি জন্ম নেয়, তবে এই শাস্তি-শাস্তি খেলা কোনদিকে গড়াবে?

ভালোবাসার খেলায় রেফারির বাঁশিতে ফ্রি-কিক পর্যন্তই যেন শাস্তি সীমাবদ্ধ হয় – হলুদ কার্ডের ব্যবহার কিন্তু লাল কার্ডের ব্যবহারের সম্ভাবনাকে আরেকটু কাছে টেনে নেয়!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *