সিটি অব গড-র এক দশক

City-of-God-Blu-ray

ক্রাইম ড্রামা ঘরানার প্রিয় ছবির তালিকায় সিটি অব গড নেই – এমন দর্শক পাওয়া কঠিন। ব্রাজিলের বস্তি এলাকায় কিশোর ছেলেরা কিভাবে ছোটবেলা থেকেই অস্ত্র আর ড্রাগের ক্ষমতায় বড় হয়ে উঠে তার নিষ্ঠুর চিত্র পাওয়া যায় সিটি অব গড চলচ্চিত্রে। ফার্ণান্দো মেরিলে পরিচালিত এই ছবি সমবয়সী দুটো কিশোরের ভিন্ন দুটো গতিপথে বড় হয়ে উঠার কাহিনী – একজন ফটোগ্রাফার, অন্যজন ড্রাগ ডিলার।

মূলত এ দুজন কিশোরের গল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর বস্তি এলাকা ‘সিডাজে জি ডিউ’ বা সিটি অব গড এর বাস্তবতা। সিটি অব গড এর দর্শকের কাছে আগামী বিশ্বের সুপারপাওয়ার পাঁচ রাষ্ট্রের অন্যতম ব্রাজিলের এই চিত্র সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না, তার প্রধাণ কারণ সম্ভবত ব্রাজিলের এই দিকটি সম্পর্কে সিনেমা দর্শকের অজ্ঞানতা। ২০০২ সালে নির্মিত এই সিনেমায় যে এলাকার গল্প বলা হয়েছে তার বর্তমান অবস্থা কিরকম সেটা তুলে ধরা হয়েছে আরেকটি ডকিউমেন্টারিতে, নাম – সিটি অব গড: টেন ইয়ারস লেটার। স্বাভাবিকভাবেই সিটি অব গড এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনেতাদের বর্তমান অবস্থা উঠে এসেছে, তবে সে গল্প পড়ে, আগে বরং সিনেমাটি যে পটভূমিতে নির্মিত সেটা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

সিটি অব গড চলচ্চিত্র

সিটি অব গড চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে পাওলো লিন্স এর একই নামের উপন্যাস থেকে। লিন্স নিজেও ছিলেন সিটি অব গড এর বাসিন্দা, তার গল্পে বলেছেন ষাটের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। সিটি অব গড বা সিডাজে জি ডিউ (Cidade de dues) হল রিও ডি জেনিরোর পাশ্ববর্তী বস্তিএলাকা – যাকে বলা হয় ফাভেলা (Favela)। রিও ডি জেনিরো সহ বড় বড় শহরগুলার আশে পাশে এরকম বেশ কিছু ফাভেলা আছে, এদের মধ্যে সিডাজে জি ডিউ সবচে বিখ্যাত, এবং তার এই বিখ্যাত হওয়ার পেছনে একই নামের চলচ্চিত্রটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

চলচ্চিত্রটি ২০০২ সালে নির্মিত হলেও এ ফাভেলাগুলো গড়ে উঠে গত শতকের সত্তরের দশকের দিকে – যখন ব্রাজিলে উন্নয়নের ছোয়া লাগে। সে সময় ব্রাজিলের গ্রামগুলো থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় মানুষ ছুটে আসে রিও ডি জেনিরোর দিকে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ব্রাজিলের রাজধানী তখন রিও থেকে সরিয়ে ব্রাজিলিয়া-তে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ফলে, ছুটে আসা এ সকল মানুষের জীবিকার সংস্থান করতে পারে নি রিও ডি জেনিরো এবং সব ফেলে ছুটে আসা মানুষগুলো হঠাৎ দারিদ্র্যের মুখে পড়ে।

নানা কারণে ব্রাজিলের তৎকালীন সামরিক সরকার এ সকল উদ্বাস্তু মানুষকে রি্ও-র পাশ্ববর্তী এলাকায় পাবলিক হাউজিং এর ব্যবস্থা করে দিয়ে শহর থেকে সরানোর ব্যবস্থা করে। এই পাবলিক হাউজিংগুলোই ফাভেলা নামে পরিচিত। সরকার হাউজিং এর ব্যবস্থা করে দিলেও সেখানে অন্যান্য নাগরিক সুবিধাগুলো পর্যাপ্ত পরিমানে প্রদান করে নি, তার উপর ছিল দারিদ্র্য। ফলশ্রুতিতে ড্রাগ, অস্ত্র, অন্যায়-অবিচারের আখড়া হয়ে উঠে ফাভেলাগুলো – তারই এক বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে ‘সিডাজে জি ডিউ’ বা ‘সিটি অব গড’ চলচ্চিত্রে।

যারা সিটি অব গড চলচ্চিত্রের বাহিরে আগ্রহী হয়েছেন তারা জানেন চলচ্চিত্রের বেশীরভাগ অভিনেতাই সিটি অব গড সহ আশেপাশের দু-একটি ফাভেলার বাসিন্দা। লিল জি চরিত্রে লিওনার্দো ফার্মিনো, রকেটের বান্ধবী চরিত্রে অ্যালিস ব্রাগা, নকআউট নেড চরিত্রে সিউ হোর, ব্ল্যাকি চরিত্রে রুবেন্স স্যাবিনো দা সিলভা, তিন চোরের দল ‘টেন্ডারস ট্রায়ো’র অন্যতম জেফ সাপ্লিনো ইত্যাদি মানুষগুলো এখন কে কি অবস্থায় আছে তা জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসি-র রিপোর্টার ডোনা বোয়াটার। অতি সম্প্রতি বিবিসিতে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে তিনি তাদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন।

সিটি অব গড সিনেমার দৃশ্য
ডানদিক থেকে দ্বিতীয় এই লোকটিই লিল জি বা লিওনার্দো ফার্মিনো। ফাভেলা থেকে উঠে এসে এখন সে সেলিব্রেটি।

এখন কে কোথায়

লিওনার্দো ফার্মিনো’র (লিল জি) বয়স এখন ৩৫ এবং তিনি পৌনে দুবছর বয়সী এক সন্তানের পিতা। সিটি অব গড চলচ্চিত্রের পর ফার্মিনো আরও কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এদের মধ্যে Outback (2005), The man who challenged the devil (2007), In the eye of the street (2010) অন্যতম। ফার্মিনো এখনো অভিনয় করছেন এবং করে যেতে চান। সিডাজে জি ডিউ ফাভেলায় তিনি মোটামুটি পরিচিত লোক, দশ বছর পার হয়ে গেলেও তার চলচ্চিত্রটি এখনো বেশ জনপ্রিয়।

২০১১ সালে বারাক ওবামা ব্রাজিলে ফাভেলা ঘুরতে এলে ফার্মিনোকে রিসেপশন পার্টিতে যোগদানের আহবান জানানো হয়েছিল, কিন্তু ফার্মিনো যান নি – তার ভাষায় – “Barack Obama’s visit to Cidade de Deus was a political thing.” মজার ব্যাপার হল, নিজেকে সেলিব্রেটি হিসেবে ভাবতে ফার্মিনোর ঘোরতর আপত্তি, সেলিব্রেটি শব্দটা তার কাছে বেশ হাস্যকর। বিবিসির সাক্ষাতকারে বলেছেন দারুন এক কথা – শিল্প মানুষকে কাছে টানে, সেলিব্রেটি দুরত্ব তৈরী করে। এখনো সিডাজে জি ডিউ-তেই থাকছেন লিওনার্দো ফার্মিনো, থাকবেন সেখানেই।

সিটি অব গড সিনেমায় রকেটের বান্ধবী চরিত্রে অভিনয় করেছিল অ্যালিস ব্রাগা। সিবিচে রকেটকে দেয়া চুমুর দৃশ্যে অভিনয় করে সে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। উইল স্মিথের সাথে আই অ্যাম লিজেন্ড চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল অ্যালিস, অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করতে সাহায্য করেছে সিটি অব গড চলচ্চিত্রটি।

লিওনার্দো ফার্মিনোর মত আরও অনেকেই ফাভিলোগুলো থেকে উঠে এসে জনপ্রিয় হয়েছেন, তাদের অনেকে এখনো থাকেন ফাভিলোগুলোতে, অনেকে ছেড়ে চলে গেছেন আরও ভালো কোন জায়গায়। নকআউট নেড চরিত্রের অভিনেতা সিউ হোর এখন ব্রাজিলের সেরা মিউজিশিয়ানদের একজন, লন্ডন অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করেছিল সে।

ফার্মিনো, অ্যালিস বা সিউ হোরের মত সবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। তিন চোরের একজন জেফ সাপ্লিনো উধাও হয়ে গেছে – বেচে আছে না মরে গেছে নিশ্চিত করে বলতে পারে না কেউ। ডকিউমেন্টারী নির্মাতা ধারনা করেন জেফ মরে গেছে, কিন্তু জেফের মা’র দৃঢ় বিশ্বাস – সেফ এখনো বেচে আছে। ব্ল্যাকি চরিত্রে অভিনয় করা রুবেন্স সাবিনো ডি সিলভা ২০০৩ সালে বাসে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল। সেসময় সিটি অব গডের পরিচালকে ফার্নান্দো মেরিলে-র সহযোগিতা চেয়েছিল সে, অভিযোগ করেছিল তার অভিনয়ের সম্মানী থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে।

এক দশক পরে

সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য ফাভিলোগুলোর অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অস্ত্র আর ড্রাগ ব্যবসায় কমেছে, খুনোখুনির হার কমেছে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০০৮ সালে গড়ে ৩৬টি খুন হতো, ২০১২ সালে সেটা কমে গিয়ে ৫ এ দাড়িয়েছে। সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে ফাভেলাগুলোর অবস্থার উন্নয়নের জন্য। স্যানিটেশনের ব্যবস্থা বেড়েছে, শিক্ষার সুযোগ তৈরী করা হয়েছে – সবচে বড় কথা, ফাভিলোগুলোতে পরিবেশ নিয়ন্ত্রনের জন্য সেখানে পুলিশ থাকছে সবসময়।

দশ বছর বাদে সিটি অব গড এর উপর নির্মিত এই ডকিউমেন্টারী আশার সঞ্চার করে। দিল্লীর বস্তি এলাকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত স্লামডগ মিলিয়নিয়ার নিয়েও হয়তো এরকম ডকিউমেন্টারী তৈরী হবে একদিন। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অভিনীত ব্লাড ডায়মন্ড সিনেমার পরবর্তী অবস্থা নিয়েও সিনেমা নির্মিত হওয়া প্রয়োজন। বাস্তবতা যেন পাল্টে যায় ডকিউমেন্টারী নির্মানের আগেই – শুভকামনা।

তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া: সিটি অব গড
উইকিপিডিয়া: ফাভেলা
উইকিপিডিয়া: সিডাজে জি ডিউ
বিবিসি: সিটি অব গড: টেন ইয়ারস অন
আইএমডিবি: সিটি অব গড

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *