জ্বর হবার আগে জ্বরের গল্প

২০১০ এর আগস্ট মাসের কথা। 

একটা বিল্ডিং এর ছাদে এক ছোট রুমে আমরা তিনজন থাকি। ক্লাস শেষ, র‌্যাগ ডে হয়ে যাওয়ার পরই পরীক্ষা শুরু হবে – এমন সময় আমার জ্বর এল। 

জ্বরের গল্পটা খুলে বলি। হাবিজাবি ভাজাপোড়া কিছু খাওয়ার ফলে পেটে গ্যাস ফর্ম করেছে (অ্যাসিডিটি)। কেমন দম আটকে থাকা অবস্থা। মাঝে মাঝে এরকম হয় – অ্যাসিডিটির ট্যাবলেটে কাজ হয় না। তখন অপেক্ষা করতে হয়। দুভাবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটে। এক, অ্যাসিডিটি ডিসেন্ট্রির দিকে টার্ন করে দিন দুই-তিন ঘর-টয়লেট-ঘর করার মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। দুই, বমি হয়ে জ্বর এসে দিন তিনেক ভুগিয়ে তারপর সুস্থ্য। দ্বিতীয়টা পছন্দনীয়, কিন্তু সামনে পরীক্ষা থাকার কারণে প্রথম পদ্ধতিতে মুক্তির জন্য দোয়া করছিলাম। পাপীর দোয়া! উল্টো ফল হল। বমি হয়ে জ্বর চলে আসল। কিন্তু তিনদিন পর বিদায় নিল না।

সে এক অদ্ভুত অবস্থা। জ্বর বাড়লে একশ চার, কমলে একশ দেড়-দুই। এর নিচে আর নামে না। রুমমেটরা সকালে বের হয়ে যায়, আমি সারাদিন একা রুমে শুয়ে থাকি। মাঝে মাঝে বাথরুমে গিয়ে গা মুছে আসি, মাথায় পানি দিই, ফোনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অষুধ খাই – কিন্তু কোন লাভ হয় না। সাতদিন যাওয়ার পর অবস্থার উন্নতি হল। জ্বর একশ চারে গিয়ে স্থির হল – নামা নামি নাই। অষুধ খাই, ঘাম দেয়, শরীরের খাতা কম্বল ফেলে দিতে হয়। অনেক আগ্রহ নিয়ে জ্বর মাপি – ১০৪। যখন খুব কাপুনি হয়, তখন ভাবি এবার নিশ্চয়ই ১০৫ পার হয়ে যাচ্ছে – উহু। সেই ১০৪।

জ্বর যদিও একশ চার, তাতে আমার শরীরের খুব প্রভাব পড়ে নি। আমি জ্বরের ঘোরে অচেতন হই না, প্রলাপ বকি না – লোকজন দেখতে আসে প্রতিদিন, তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলি, শুয়ে শুয়ে কানে হেডফোন দিয়ে সিনেমা দেখি অল্প অল্প করে। যখন এসবও বিরক্ত লাগে, তখন হাতের কাছে থাকা একটা আবৃত্তি কবিতার সংকলন তুলে নেই – তারপর কবিতা পড়ি শব্দ করে। নির্মলেন্দু গুন,সুনীল গাঙ্গুলী, তসলিমা নাসরীন, রুদ্র শহীদুল্লাহ, হুমায়ূন আজাদ। ‘তোমার চোখ এত লাল কেন’ – এই কবিতাটা তখন আমার মাথায় ঢুকে গেল। একা একা জ্বরে ভুগছি – আর নির্মলেন্দু গুন সেটা জানতে পেরে আমার জন্য একটা কবিতা লিখে দিয়েছে – ব্যাপারটাই অন্যরকম। যারা দেখতে আসে তাদেরকে বসিয়ে আমি আমার জন্য লেখা গুণ সাহেবের কবিতাটা পড়ে শোনাই। 

এর মাঝে খবর পেলাম ব্লগার ইশতিয়াক জিকো’র শর্ট ফিল্ম ‘৭২০ ডিগ্রি’ বার্লিন উৎসবে দেখানোর জন্য মনোনীত হয়েছে। খুবই আনন্দের সংবাদ। আমি উঠে বসে একটা সংক্ষেপে পোস্ট লিখে ফেললাম – কনগ্রাচুলেশন পোস্ট: ইশতিয়াক জিকো এবং তার ৭২০ ডিগ্রি।

সপ্তাহ দেড়েক যাবার পর হাসপাতালে গেলাম স্পেশালিস্ট দেখাবার জন্য। ভদ্রলোক আমাকে দু ধরনের টেস্ট দিলেন – ব্লাড এবং ইউরিন। দ্বিতীয়টায় আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু প্রথমটার কারনে আমার হৃদপিন্ড আলজিহ্বার কাছাকাছি চলে এল। সিস্টার ভদ্রমহিলা আমার হাতে শুই ঢোকাবেন, আর আমি মনযোগ সরিয়ে রাখার জন্য এক পিচ্চির সাথে দুষ্টামি করছি। কিন্তু কোথায় কি! ভদ্রমহিলা দুই সিরিঞ্জ ব্লাড নিয়ে নিলেন – সর্বোনাশ, এখন যদি আমাকেই ব্লাড দেয়া লাগে? ডোনার পাওয়া যাবে তো?

ডাক্তার ধারনা করছিলেন জন্ডিস। উহু, তা নয়। বাঁচা গেল। তাহলে কি টাইফয়েড? এইবার আমার সত্যিই ভয় লেগে গেল। আমার মেজ ভাইয়ের এসএসসি পরীক্ষার পর তিনমাস টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। মুহতারাম আজরাইল আসেন আর যান। আমার বেলায় আসলে প্রথমবারেই নিয়ে যাবেন – এই টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ। কিন্তু টাইফয়েডও ধরা পড়ল না – সাধারণ জ্বর।

আমার অসুস্থ্যতার খবর শুনে আব্বা চলে এলেন ঢাকায়। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, আব্বা কপালে হাত রাখলেন। আমি চোখ খুলে বললাম – ‘আব্বা আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন?’ আব্বা মাত্র একদিন ছিলেন, কিন্তু তিনি দুটো কাজ করেছিলেন। এক, আমাকে একরুমের ঘর থেকে আমার খালার বাসায় যেতে বাধ্য করলেন এবং, দুই, কপালে হাত দিয়ে আমাকে সুস্থ্যতার দিকে ফিরিয়ে নিলেন। আমার জ্বর ১০৪ থেকে ১০১-এ নামল।

মোট বাইশ দিন বিছানায় শুয়ে ছিলাম। এর মাঝে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে, আমি অ্যাটেন্ড করে ফেল ঠেকিয়েছি। খালার বাসায় মোটামুটি পিকনিক পরিবেশে জ্বরের শেষ কটা দিন কাটালাম। খালু প্রতিদিনই নানা রকম ফলমূল নিয়ে আসেন, পিচ্চি খালাতো বোনটা নানা স্টাইলে আমার সাথে খেলে। আমার উপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে একবার বিছানায় ওঠা আরেকবার বিছানা থেকে নামা তার মধ্যে একটি। 

আড়াই বছর বাদে আবারও জ্বর সাহেব ফিরে এসেছেন। দশ মিনিটের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১০১-এ পৌছেছে তাপমাত্রা। আমি যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করার চেষ্টা করেছি – থার্মোমিটার জোগাড় হয়েছে, ট্যাবলেট বের করে হাতের নাগালে রাখা হয়েছে, বালিশের পাশে বই মজুদ করা হয়েছে, রুমমেটকে প্রাথমিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে – বাকী ছিল এই স্ট্যাটাস। ফেসবুকে যারা লিখেন তারাও লেখক এবং লেখকদের একটা সমস্যা হল – মাথায় কিছু ঢুকে পড়লে সেটা না নামানো পর্যন্ত কষ্টে থাকেন। আমি স্ট্যাটাসটা নামালাম, আশা করছি জ্বরটাও আগামীকাল সকালে নেমে যাবে।

আলবিদা!

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *