লিসবেথ স্যালান্ডারের জনক স্টিগ লারসন সম্পর্কে পড়তে ক্লিক করুন
[এর পরের অংশে আলোচনার সুবিধার্থে স্পয়লার অ্যালার্ট থাকবে। সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি স্পয়লার এড়িয়ে লেখার জন্য। কিন্তু যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে কি হবে সেটাও না জানতে চান, তারা নিজ দায়িত্বে পড়বেন]
মিলেনিয়াম নামে এক পত্রিকার অন্যতম প্রকাশক ও সাংবাদিক মিকাইল ব্লুম্কভিস্ট (মাইকেল নিকভিস্ট) একজন বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা সংক্রান্ত মামলায় হেরে যায় এবং জরিমানা সহ ছয়মাসের দন্ডে দন্ডিত হয়। শাস্তি শুরু হবার আগেই তার কাছে একটি প্রস্তাব আসে। হেনরিক ভ্যাঙ্গার নামে অত্যন্ত ধনী এক পরিবারের কর্তা তার নাতনীর হত্যারহস্য সমাধানে আহবান জানান। নাতনীর নাম হ্যারিয়েট যে চল্লিশ বছর আগে নিখোজ হয়ে যায় এবং তার অন্তর্ধান বা খুনের পেছনে এই পরিবারেরই কেউ একজন জড়িত - তাকেই খুজে বের করতে হবে। ভ্যাঙ্গার পরিবারের নিজস্ব দ্বীপের এক কোনে নির্জন বাড়িতে গবেষনা করার সময় মিকাইল বুঝতে পারলেন তার কম্পিউটার কেউ হ্যাক করেছে এবং কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। খুজতে গিয়ে জানা গেল এই হ্যাকার একজন মেয়ে, তার নাম লিসবেথ স্যালান্ডার (নুমি র্যাপেস)। এই লিসবেথ স্যালান্ডারের পিঠ জুড়ে আকা বিশাল ড্রাগন ট্যাট্যু তাকে বানিয়েছে ড্রাগন ট্যাট্যুড গার্ল এবং তাকে কেন্দ্র করেই মিলেনিয়াম ট্রিলজি আবর্তিত। হ্যারিয়েট রহস্য সমাধানের কাহিনী নিয়ে দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাট্যু সিনেমা নির্মিত হলেও এটি ট্রিলজির ভূমিকা মাত্র। এই সিনেমার মাধ্যমে সম্পূর্ন ট্রিলজির পাত্রপাত্রী, ঘটনাসূত্র ইত্যাদির সাথে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে মাত্র। মূল গল্প বাকী দুই পর্বে।
লিসবেথ স্যালান্ডারের পরিচয় দেয়া হয়েছে - শি ইজ ডিফারেন্ট। সে কতটা ডিফারেন্ট সেটা প্রতিটিই সিনেমায় খুব স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। চিকন শরীর, ছোট বব করে কাটা কালো চুল। কানে নাকে সব মিলিয়ে প্রায় সাতটা রিং। চোখের পাতা ও আশে পাশের অংশ কালো রং এ ঢাকা, মাথার চুল এক সামনের দিকে ঝুলে থেকে এক চোখ ঢেকে রেখেছে। পোশাক দেখে ছেলে-মেয়ে পার্থক্য করা দুষ্কর। অসামাজিক। সমকামী। খুব দ্রুতগতিতে এক্সেল বাইক চালায়। নির্ভীক। দক্ষ হ্যাকার এবং টেকি। প্রতিশোধপরায়ন। ট্রিলজির তিনটি পর্বেই লিসবেথ স্যালান্ডার তার এই 'ডিফারেন্ট' পরিচয়কে স্পষ্ট করেছে। ড্রাগন ট্যাট্যু সিনেমায় জার্নালিস্ট মিকাইলকে আড়ালে থেকে এবং সরাসরি সহায়তা করার পাশাপাশি বিভিন্ন ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে লিসবেথের অতীত সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অবশ্য সিনেমার শুরুতে প্রায় সাতাশ বছর বয়সী মেয়েটির একজন আইনী অভিভাবকের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে তার অস্বাভাবিক অতীত সম্পর্কে ধারনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
[caption id="" align="alignright" width="384"]

ড্রাগন ট্যাট্যুর হলিউড ভার্সনে লিসবেথ তুলনামূলকভাবে বেশী ডার্ক, আকর্ষনীয় উপস্থিতি। তার বাহন বাইকটিও সুইডিশ ভার্সনের তুলনায় সুন্দর। কিন্তু হলিউডের লিসবেথ সুইডিশ লিসবেথের তুলনায় কম প্রকাশিত। এখানেও লিসবেথ জার্নালিস্ট মিকাইলকে সাহায্য করে বটে, কিন্তু মেজর সমস্যাগুলোর সমাধান মিকাইল-ই করে। সে দিক থেকে ড্রাগন ট্যাট্যু সিনেমার হিরো আর ড্রাগন ট্যাট্যুড গার্ল থাকে না, হয়ে যায় মিকাইল। ডেভিড ফিঞ্চারের পরিচালনায় ড্রাগন ট্যাট্যু সিনেমার এই রূপান্তরের উদ্দেশ্য বোধহয় এক পর্বেই সিনেমাকে সীমাবদ্ধ রাখা। হলিউড ড্রাগন ট্যাট্যুর সবচে বিরক্তিকর দিক হল - লিসবেথকে শেষ পর্যন্ত মিকাইলের প্রতি অনুরক্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। সুইডিশ সিনেমার ক্ষেত্রে বাকী দুই পর্বের কথা চিন্তায় ছিল, ফলে লিসবেথ স্যালান্ডার এখানে অনেক বেশী প্রকাশিত, অনেক বেশী কর্মঠ, যোগ্য।
ড্রাগন ট্যাট্যু সিনেমায় বিভিন্ন ফ্লাশব্যাকের মাধ্যমে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল, দ্য গার্ল হু প্লে্ইড উইথ ফায়ার সিনেমায় তা বিকশিত হয়েছে। প্রথম সিনেমার সাথে দ্বিতীয় সিনেমার সম্পর্ক শুরুতেই কিছু দৃশ্যের মাধ্যমে দর্শককে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এই পর্বের গল্প প্রায় এক বছর পরে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ফিরে আসার পরে হঠাৎই তিনটে খুনের ঘটনায় ফেঁসে যায় লিসবেথ স্যালান্ডার। এদের মধ্যে দুজন আবার জার্নালিস্ট মিকাইলের পরিচিত এবং দুজনের একজন মিলেনিয়াম পত্রিকার রিসার্চার জার্নালিস্ট। তিনটি খুনের জন্যই যখন পুলিশ লিসবেথ স্যালান্ডারকে খুজছে, মিকাইল তখন স্ব-উদ্যোগে তাকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য চেষ্টা করতে থাকে এবং চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় - লিসবেথ স্যালান্ডারের অতীতের সাথে এ সকল খুন এবং লিসবেথ-কে ফাঁসানোর চেষ্টার মধ্যে নিবিড় সংযোগ রয়েছে।
তৃতীয় পর্ব দ্য গার্ল হু কিকড দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ এসে সিনেমাটি একটি কোর্টরুম ড্রামায় পরিণত হয়। নানা অপরাধে দোষী লিসবেথকে নির্দোষ প্রমাণ করাই শুধু নয়, তার ব্যক্তিগত অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য লড়াইয়ে নামে মিকাইল এবং তার বোন। মিকাইলের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে অনেক পুরানো সব ইতিহাস। উচুস্তরের কিছু সরকারী কর্মকর্তার গোপন কর্মকান্ড প্রকাশিত হতে থাকে। এদিকে, মিকাইল এবং লিসবেথের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্য সেই গোপন কর্মকর্তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠে। লিসবেথের সহায়তায় মিকাইল সংগ্রহ করে গোপন সব তথ্য আর সেই তথ্যগুলোই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় লিসবেথের পক্ষে।
[caption id="attachment_1572" align="aligncenter" width="813"]

তিনটি সিনেমাকে একত্রে দেখা হলে ড্রাগন ট্যাট্যুড একজন লেডি জেসন বর্ণকে খুজে পাওয়া যাবে। তবে জেসন বর্ণ যেখানে সরাসরি শত্রুপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে অবর্তীর্ন হয়, তার বুদ্ধি এবং দ্রুত চিন্তা করার দক্ষতা যেখানে তার অস্ত্র, ড্রাগন ট্যাট্যুড গার্ল সেখানে লড়াই করে আড়ালে থেকে, কম্পিউটারে অস্বাভাবিক দক্ষতা তার অস্ত্র। এছাড়াও স্পষ্ট হয়ে উঠে আরও কিছু বিষয়। এই ট্রিলজিতে সমাজের কিছু অন্ধকার দিককে খুব নির্দিষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। নারী পাচার, যৌন নির্যাতন, দুর্নীতি, মানুষের পৈচাশিকতা, অনিরাপদ শৈশব ইত্যাদি। সিনেমার গল্পের দিকে তাকালে দেখা যায় এর গভীরতা, নির্মান কৌশল। বিশেষ করে লিসবেথ স্যালান্ডারের চরিত্রটি স্টাডি করা যেতে পারে। সাতাশ বছর বয়সী একটি চরিত্র লিসবেথ স্যালান্ডারকে নির্মান করা হয়েছে একদম ছোটবেলা থেকে। শৈশব, কৈশোরের বিভিন্ন ঘটনাবলী আজকের লিসবেথ স্যালান্ডারকে তৈরী করেছে। তার প্রায় প্রতিটি আচরণ ও কর্মকান্ডের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার বিক্ষিপ্ত-নির্যাতিত শৈশব ও কৈশোরে।
সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন চরিত্র মিকাইল ব্লুম্কভিস্ট চরিত্রটি সম্ভবত লেখক স্টিগ লারসনের নিজের প্রতিবিম্ব। কারণ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিজেও একজন ফিনান্সিয়াল ইনভেস্টিগেটর ছিলেন। নিজের সাথে মিল রেখে কিনা জানি না, তিনি এই চরিত্রটিকে তৈরী করেছেন অনেকটা গ্ল্যামারহীন হিসেবে। এই চরিত্রটিকে আপনি ভালোবাসবেন না, কিন্তু এর প্রতি আপনার আস্থা হবে দৃঢ়, আশা করবেন অনেক বেশী।
সিনেমা তিনটা দেখার পরে দর্শক হিসেবে আপনার অবশ্যই আফসোস হবে স্টিগ লারসনের জন্য, তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতির জন্য। সন্দেহাতীতভাবে পৃথিবী দারুন একজন থ্রিলার নির্মাতাকে হারিয়েছে।
==============================================================
উৎসর্গপত্রঃ
ব্লগিং সূত্রে তন্বি নামের ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় ও যোগাযোগ বছর দুয়েকের। আজ খেয়াল করলাম - লিসবেথ স্যালান্ডারের সাথে তার সামান্য মিল রয়েছে। লিসবেথের মত তিনিও নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখেন। আড়ালের এই লিসবেথের আজকে জন্মদিন এবং এই পোস্টটা তার জন্য জন্মদিনের উপহার।
- দারাশিকো
27 মন্তব্যসমূহ
as usual... nailed it. :) চালিয়ে যান। সাথে না থাকলেও আশে পাশেই আছি। :)
উত্তরমুছুনগুড গুড ........................।। পড়ে ভালো লাগলো । আরও ভালো লাগতো যদি উৎসর্গ যাকে করেছেন তিনঃএইখানে হস্তাক্ষর ( ভার্চুয়ালি ) দিয়ে যান । :D
উত্তরমুছুন*তিনি হবে
উত্তরমুছুনভাল কোইন্সিডেন্স দেখি!
উত্তরমুছুনমিলেনিয়াম ট্রায়োলোজি টা আজ ডাউনলোড দিবো ভাবছিলাম আর আজই আপনার পোস্ট পেলাম! ;)
হলিউড ভার্সন টা দেখেছি। এবার দেখি সুইডিশ ভার্সন কেমন লাগে!
পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ দারাশিকো ভাই।
Excellent review. Keep them coming. \m/
উত্তরমুছুনপ্রথমটা দেখেছিলাম।
উত্তরমুছুনমজার বিষয় হলো ইংরেজী সাবটাইটেল ছাড়া পুরা সিনেমা দেখছি।
হিন্দী হলে কথা ছিলো- এ হলো সুইডিশ।
কি বুঝছি কে জানে?
তবুও, ভালো লাগছে।
আপনার লেখাটাও ভালো লাগল। তবে দারাশিকো ব্রান্ড হয়ে উঠে নাই।
অ্যাজ ইউজুয়্যাল কমেন্ট - আশে পাশেই থাকুন - ভালো লাগবে।
উত্তরমুছুননিচে সুজন ভাইয়ের কমেন্ট খেয়াল করেন।
লিসবেথরা নিজেদের চিহ্ন রাখার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে না। তবে তিনি যে আপনার মন্তব্য দেখেছেন - সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন :)
উত্তরমুছুনশুকরিয়া স্বর্ণমৃগ ভাইয়া।
উত্তরমুছুনযদি হলিউডের লিসবেথকে গুরুত্ব বেশী না দিয়া থাকেন, তাহলে অবশ্যই সুইডিশ ট্রিলজি ভালো লাগবে। এইরকম কারেক্টার তৈরী করাও খুব সোজা না মনে হয় :)
শুভকামনা থাকল। দেখার পর জানায়া যাইয়েন :)
Thanks Junaid Kabir. Stay with Darashiko's Blog and keep coming. Thanks again
উত্তরমুছুনপড়লাম। মজা লাগল। তবে যার যার মত তার কাছে। :)
উত্তরমুছুনযার যার কাছে থাকে না তো - এই টাইপের মত আরেকজনের কাছে বললেই হ্যাপা :)
উত্তরমুছুনআমি সব সময় ডিভিডিতেই মুভি দেখতাম। গত বছরের শেষের দিকে আমি প্রথম আনলিমিটেড নেট ব্যবহার করতে শুরু করি। মজার ব্যপার সবার প্রথম যে মুভি নামিয়েছিলাম সেটা ছিলো মিলেনিয়াম ট্রিলজি।
উত্তরমুছুনদারুন একটা ট্রিলজি। বইগুলো অবশ্য পড়া হয়নি। পড়ার ইচ্ছে আছে।
আপনার পোস্ট কখনও খারাপ হয়না। নতুন করে বলার কিছু নাই।
দারাশিকোচিত পোস্ট যে হয় নাই, সেটা সুজন ভাই বলছেন।
উত্তরমুছুনআমার ঘরে বাস করে কয়জনা? - আমি জানি না :(
vaijan apnar blog pori onek age thekei but eta first comment...:D
উত্তরমুছুনonnek valo laglo ...
:)
উত্তরমুছুনস্বাগতম শামিম।
উত্তরমুছুনভালো লাগল। আবার আসবেন :)
সুজন ভাই সুজন ভাইয়ের কথা কইছে। আমি আমার কথাই কইলাম।
উত্তরমুছুনঅহন শুধু সুজন ভাইয়ের কথাই যদি আপনার শিরোধার্য হয় তাইলে কিছূই কওয়ার নাই :p
আমার কাছে সুইডিশ ভার্সনটাই ভালো লাগসে। :)
উত্তরমুছুনapnar lekha ta porei download diyechi. hollywood version ta dekhechi. hope i will love this trilogy. movie niye amar passion onekdiner but lekhalekhi hoye othe na. chaliye jaan....
উত্তরমুছুনস্বাগতম ক্রেজি বাগ :)
উত্তরমুছুনদুই লাইন তো লিখেই ফেলেছেন, চেষ্টা করলে বোধহয় আরও লেখা সম্ভব। শুরু করুন না কেন?
ভালো থাকুন :)
Vai DVD pabo kothai? Review pore to na dakhe thakte partesi na........
উত্তরমুছুনস্বাগতম রাজিব।
উত্তরমুছুনডিভিডি কোথায় যে পাবেন সেটা তো জানি না ভাই। ভালো যে কোন ডিভিডির দোকানেই পাওয়া যায়। একটু খোজ নিলেই পাবেন আশা করি।
আবারও আসবেন। ধন্যবাদ।
the girl with dragon tatto dekhchi...osam!!!
উত্তরমুছুন2015 তে এসে আবার কমেন্ট করলাম। আপনার Review দেখে পুরো ট্রিলজি তা দেখে ফেলেছিলাম।
উত্তরমুছুনআন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রিয় তৌফিক হাসান :)
উত্তরমুছুন[…] থেকেই পরবর্তীতে সুইডিশ ভাষায় ‘মিলিনিয়াম ফিল্ম ট্রিলজি‘ নির্মিত হয়। তিনটি সিনেমাই যে সফল […]
উত্তরমুছুন