এত ভালোবাসা ছিল আমাদের মাঝে !

আজকে শেষ ক্লাস এজন্য যতটা মন খারাপ তার চেয়ে আফসোসটা বেশী ছিল।

মুবিনা ম্যাডামের ক্লাস দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু, আজকে রাফি স্যারের ক্লাস দিয়ে শেষ। শেষ সবসময়ই একটু অন্যরকম। শেষ তো শেষ নয়, অন্য কোন কিছুর শুরু। কিন্তু তারপরও নতুন কিছু শুরুর তুলনায় শেষটাই বড় হয়ে দাড়ায়। ছয়বছরের একত্রে ক্লাস-অ্যাসাইনমেন্টস-প্রেজেন্টেশনস-এক্সামস-রেজাল্টস – যবনিকা পড়লো বলে। ছ-য়-ব-ছ-র – মোটেও কম সময় নয়।

ভার্চৃয়াল ভালোবাসা-বন্ধুত্বের এই যুগে দুরত্ব হাতের মুঠোয়। ফেসবুকে লগিন করেই ‘হাই’ বললেই দুরুত্ব নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও তো কথা থাকে – চোখেরো আড়াল হলে মনেরো আড়াল। ক্লাসের কল্যানে তিনঘন্টা একটা ফ্লোরে দাড়িয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় আ্ড্ডাবাজি-খুনসুটি-হাসাহাসি-ছোটাছুটি হয়েছে, ফেসবুকে কিংবা মোবাইলে হাই-হ্যালো হবে, কিন্তু তোমাদেরকে ছুয়ে দেয়া কি হবে? হঠাৎ কোন রাস্তায়, কোন অফিস কিবা ফাংশনে হারিয়ে যাওয়া মুখ ডেকে তো বলবেই – বন্ধু কি খবর বল? কতদিন দেখা হয় নি … কিন্তু তারপরেই কি বলতে হবে না – দোস্ত এখন যাইরে – মিটিং আছে, এক্ষুনি ধরতে হবে।

তুষ্ণীম একটা ডাইরী আর কলম বাড়িয়ে দিয়ে বললো – উইশবুক, কিছু লিখে দাও। আফরিন আজহারের খাতায় হয় না, কলমেও বিশ্বাস নেই – সে নিয়ে এসেছে একটা টি-শার্ট আর একটা মার্কার; কথা হয়নি কোনদিন, কিন্তু নোটবুকটা বাড়িয়ে দিলে নিঘাত বর্ষাকে কি ফিরিয়ে দেয়া যায়? উইশবুকে উইশ করে দেয়াটা কত নির্বুদ্ধিতা, তাই না? আমার জন্য তুমি বরাদ্দ করেছো একটা মাত্র সাদা পৃষ্ঠা, সময় দিয়েছো লেখার জন্য বড়জোর পাচ মিনিট – তোমার জন্য আমি দুম করে একটা উইশ লিখে দিয়েছি সত্য – কিন্তু সেটাই কি শেষ কথা, সেটাই কি সব কথা? সেই ছ’বছর আগে থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এবং বিশ্বাসীদের জন্য মৃত্যুর পরের জীবনের জন্যও তোমার জন্য আমার যে শুভকামনাগুলো ছিল, আছে এবং থাকবে তার জন্য ডায়রীর একটা পৃষ্ঠা তো নিতান্তই সামান্য, ক্ষুদ্র এবং নশ্বর। তোমার জন্য হৃদয়ের উইশবুকে যা লেখা আছে তার প্রতিনিধি হলো যা লিখে দিয়েছি তোমার কাগজের উইশবুকে, আমি যা লিখেছি তার চে’ ঢের বেশী উইশ আমি লিখিনি বন্ধু।

শেষ একটু বিষাদময় হবে এটাই তো জানতাম। সব্বাই দলবেধে ছবি তুলবে, আমরা উইশবুকে একটু আধটু ভারিক্কি কথাবার্তা লিখে দেবো, মেয়েরা কাঁদবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ডাবল বিবিএ-ডিগ্রিধারী আসিফ যখন ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে বলে – ‘মাফ কইরো’ – তখন তো আমি বলবোই যে  ‘তোকে শালা মাফ করবোই না।’ মাফ করলেই ভুলে যাবি, মাফ না করলে কেয়ামত পর্যন্ত মনে রাখবি। হাশরের ময়দানে মাফ চাওয়ার জন্য হলেও তুই আমাকে খুঁজে বেড়াবি – তথন তোকে জড়িয়ে ধরে আমি বলবো, মাফ তো কবেই করছি, কিন্তু বললে কি তুই আমাকে এইখানে খুঁজে বের করতিস?

ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে – এই নিয়ে আমাদের যত দু:খ, শুভ ফাহিম চৌধুরী (CFC)র দু:খ আরও বেশী। কোন এক পরীক্ষায় পাঁচতলার বাথরুমে বিড়ি টানতে টানতে সে বলেছিল – ইউনিভার্সিটি শেষ করলেই বিড়ি খাওয়াও শেষ। সেই বাচ্চাকালের সংগী, পলমল টেনে গলায় সমস্যা হলেও যাকে ছাড়েনি – তার সাথেও বিদায়ের সময় হয়ে এলো। শুভর দু:খ তো লাগবেই। লাগুক, কিন্তু শুভ যেনো বিড়ি খাওয়া বন্ধ করে, দৈনিক ১৪ থেকে নেমে ৪টে বিড়িতে অভ্যস্ত হওয়া তুষার যেনো ২এর বেশীতে কখনোই না যায় – এই উইশ কি আমরা শুধু উইশবুকে লিখি, এটা আমাদের অন্তরে আছে আরও লাখো উইশের সাথেই।

বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আমদানী হবে কি হবে না – এই নিয়ে রায়হান মাহমুদের সাথে আমার ঝগড়া হবেই, আমি বিপক্ষে কথা বলবোই, কিন্তু তাই বলে এত বিশাল বপু নিয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদবে? আমাদের ক্লাসের গুডবয় রিফাত সাগর, রাব্বি, আজাদ ইকবাল যদি কাঁদে তবে মেহেদী কেন চুপচাপ বসে কাঁদবে না? আর শহীদুজ্জামান ফয়েজ তো অবশ্যই তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবে না, কারণ ওটাই তো তার অবলম্বন, চেয়ারটাই তো তাকে সবার সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে বাধা দিচ্ছে – ফয়েজ উঠে দাড়ালে কি তার সাথে কান্নাও ভেংগে পড়বে না? তারচে’ সে ওখানেই থাকুক।

এই যে উইশবুক, এই যে কান্নাভেজা চোখে হাসিমুখে ছবি তোলা, এই যে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়া, হোয়াইট বোর্ডে লিখে সাবিদের নির্লজ্জের মতো সবার বিয়ের দাওয়াত চাওয়া – অনেক বীণে তো একটাই সুর তোলে। ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা। এত ভালোবাসা ছিল আমাদের মধ্যে? এত?

যেখানেই থাকিস যেভাবেই থাকিস ভালো থাকিস বন্ধু।

About দারাশিকো

আমি নাজমুল হাসান দারাশিকো। লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি। পেশাগত এবং সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে অবশ্য এই ভালোবাসা এখন অস্তিত্বের সংকটে, তাই এই ওয়েবসাইটকে বানিয়েছি আমার সিন্দুক। যোগাযোগ - darashiko(at)gmail.com

View all posts by দারাশিকো →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *